আত্মনির্ভরশীলতা (রচনা)
ভূমিকা :
স্বাবলম্বন অর্থ নিজের ওপর নির্ভর করা।অন্যের ওপর নির্ভরশীল ও সাহায্য – সহযোগিতার প্রত্যাশা না করে নিজের মেধা , বুদ্ধিও বিবেক এবং নিজের হাতকে কাজে লাগিয়ে জীবনের সর্বস্তরে সাফল্য অর্জন করাই হলো স্বালম্বন বা স্বনির্ভরতা । অর্থনৈতিকস্বনির্ভরতা বলতে কোনো দেশকে অন্য দেশের সাহায্যের ওপর নিত করা বোঝায় । বস্তুত বিশাল এ পৃথিবীতে কোনো দেশ বাকোনো জাতিই সার্বিকভাবে স্বনির্ভরশীল নয় । এ পৃথিবীতে প্রকৃতির নিয়মেই প্রত্যেককে পরস্পরের দ্বারস্থ হতে হয় । কিন্তু এইদ্বারস্থ হওয়াটা ভিক্ষার সামিল যাতে না হয় , সেটাই মুখ্য বিষয় । স্বনির্ভরতা আমাদেরকে সেই শিক্ষাই দেয় যাতে জাতীয় সমৃদ্ধিতেসমৃদ্ধশালী হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি নয় , বরং প্রয়োজনে বিনিময়ের মাধ্যমে কোনো কিছু চাওয়া ও পাওয়া যেতে পারে ।
স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা :
কোনো দেশ ও জাতির জন্য স্বনির্ভরতা যেমন আশীর্বাদস্বরূপ , তেমনি পরনির্ভরতা অভিশাপস্বরূপ।অর্থনৈতিক পরনির্ভরতাব্যক্তি ও জাতির আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস যেমন বিনষ্ট করে , তেমনি তার কার্যোদ্যমও শিথিল করে দেয় । তাই প্রত্যেকদেশ ও জাতির জন্য স্বনির্ভরতার প্রয়োজন ও এর গুরুত্ব সর্বাধিক । অবশ্য বর্তমান বিশ্বের ব্যাপক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিরপরিপ্রেক্ষিতে কোনো দেশ বা জাতি অন্য কোনো দেশ বা জাতির সাহায্য সহযোগিতা না নিয়ে নিজের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে রক্ষাকরতে পারে না । এ প্রসঙ্গে আমেরিকার কথা বলা যেতে পারে । আমেরিকা আজ ঐশ্বর্যে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ । বিশ্বের বহুউন্নয়নশীল দেশ আমেরিকার সাহায্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে । অথচ আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের ওপরঅনেকাংশে নির্ভরশীল । প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান ও জার্মানি উৎপাদন বৃদ্ধি তথা স্বনির্ভরতা অর্জনে বিস্ময়করঅগ্রগতি সাধন করেছে । উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করারজন্য বিদেশি দ্রব্য আমদানি বন্ধ করে দিয়ে দেশের জনশক্তি ও পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে মিল – কারখানার এত উন্নয়ন সাধনকরেছে যে , বর্তমানে তাদের দ্রব্যসামগ্রী মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দখল করে রেখেছে ।সুতরাং প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে আত্মসম্মাননিয়ে বেঁচে থাকতে হলে আমাদেরকে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে । আমাদেরকে অর্জন করতে হবে আত্মনির্ভরশীলতা , অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা । অন্যের সাহায্য – সহযোগিতা আমরা গ্রহণ করব ঠিকই , কিন্তু তার মাত্রা সম্পর্কে আমরা সব সময়ইথাকব সচেতন । অন্যের মুখের দিকে না তাকিয়ে আমরা সব সময়ই নিজের হাতের দিকে তাকাব । আমাদের মেধাশক্তি , বিপুলজনশক্তি , প্রাকৃতিক সম্পদ , আত্মসচেতনতা ও কর্মৎপরতা অবশ্যই একদিন আমাদেরকে স্বনির্ভর করে তুলবে।
আমাদের অবস্থান :
প্রায় দু‘শ বছর ইংরেজদের শোষণ ও পঁচিশ বছর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের অর্থনীতিকে যথেষ্ট ক্ষতি করেছে । অন্যদিকেদেশে জনসংখ্যা বেড়েছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে । তাছাড়া প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ– বন্যা , খরা ও জলোচ্ছাসে ফসলহানি হয়েছেপ্রচুর । তাই দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে অত্যন্ত প্রকটভাবে। ফলে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছেদারুণভাবে । প্রতি বছর দেশ থেকে আঁচামাল ও জনশিক্ত রপ্তানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে , তার সিংহভাগইব্যয় হচ্ছে খাদ্যশস্য আমদানিতে । তাই দেশে কোনো প্রকল্প অর্থের অভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা যাচ্ছে না । কৃষিক্ষেত্রে ফলনবাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সার আমাদের দেশে নেই । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্যআমাদেরকে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় । এমনকি প্রয়োজনীয় কারিগরি ও বিশেষ জ্ঞানের জন্যও আমরা বিদেশেরমুখাপেক্ষী।এসব সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে স্বনির্ভরতার দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না।
গৃহীত পদক্ষেপ :
বর্তমানে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য দেশে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে । বিশেষভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশেরঅর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন সাধনে সরকার কার্যকরি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন । আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করে , উন্নতসার ও বীজ ব্যবহার করে এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে তিনটি ফসল উৎপাদন করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য । এজন্য স্বনির্ভরঢাকা , উর্বরা ময়মনসিংহ , সবুজ কুমিল্লা , শ্যামল সিলেট ইত্যাদি নামে বিভিন্ন জেলায় পৃথক পৃথকভাবে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধিরপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে । দেশে বর্তমানে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলছে । সরকার গৃহীত পদক্ষেপেবর্তমানে গ্রামে গ্রামে পতিত ও শুকিয়ে যাওয়া পুকুরগুলো সংস্কার করে মৎস্য চাষ বাড়াবার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে । রাস্তারদু‘পাশে বৃক্ষরোপন অভিযান জোরদার করে ফলমূল ও জ্বালানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে । কুটির শিল্পকে সারাদেশেপুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে । দেশের বেকার জনশক্তিকে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অধীনে এনে ভিক্ষুকের হাতকেকর্মীর হাতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে । হাঁস – মুরগির খামার ও পশু – পালনের প্রতি দেশের জনসাধারণকে উৎসাহিত করাহচ্ছে । দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শহরে – গ্রামে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে । যৌতুক প্রথা বিরোধীআইন প্রণয়ন করে জাতীয় জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা চলছে । নিরক্ষরতা দূরীকরণের মাধ্যমে শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলারকার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলেছে । কৃষিঋণ ও সমবায় ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে জনসাধারণকে সার্বিকভাবে স্বনির্ভরতার দিকেএগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ কুরা হয়েছে । পাঠ্যসূচিতে কৃষি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । সুতরাংআশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আরও বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বনির্ভরতার আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নেয়াযাবে।
উপসংহার :
জাতীয় জীবনে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যেই বর্তমানে দেশে সবুজ বিপ্লব , কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি , খাল খনন কর্মসূচি , বৃক্ষরোপণ অভিযান , নিরক্ষরতা দূরীকরণ , শিল্প বিপ্লব প্রভৃতি পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে । এ লক্ষ্যে সরকারের করণীয় পদক্ষেপেরপাশাপাশি জনসাধারণের অংশগ্রহণের সাফল্যও বহুলাংশে নির্ভরশীল । কৃষক , সরকারি কর্মচারী , স্থানীয় প্রশাসন , ছাত্রসমাজ , শ্রমিক , সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সকলেই যদি সততার ভিত্তিতে দেশের সার্বিক উন্নয়নে যথাযথভাবে স্বীয়দায়িত্ব পালন করে , তবে আমাদের দেশ বিশ্বের – মানচিত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনে সম্মানজনক একটি আসন গ্রহণে সক্ষম হবে।