বাংলা রচনা সমগ্র

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস / বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস (রচনা)

ভূমিকা :

একুশে ফেব্রুয়ারির কথা বলতেই এসে যায়আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি জাতীয় জীবনে এমন দুএকটি দিন আসে যাস্মৃতিমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে , চিরভাস্বর হয়ে থাকে মনের মণিকোঠায় এমনই স্মৃতিবিজড়িত মহিমা উজ্জ্বল একটি দিনএকুশে ফেব্রুয়ারি।প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনে বেদনাবিধূর স্মৃতি সংগ্রামী চেতনার অমিয়ধারাকে বহন করে একুশে ফেব্রুয়ারিআমাদের দ্বারে এসে হাজির হয় নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা অমরঅক্ষয় করে রাখার জন্য অনেক তরুণকে রক্তাক্ত হয়েজীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে বলে এই দিনটি রক্তে রাঙানো দিন। আজ বিশ্বের দরবারে একুশে ফেব্রুয়ারিআন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবসহিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

মাতৃভাষার গুরুত্ব:

কবি বলেছেন , ‘ বিনে স্বদেশি ভাষা মিটে কি আশা’- মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক মাতৃভাষা একটি জাতিরঐতিহ্যের ধারক মর্যাদার প্রতীক অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্যামুয়েল জনসন ( Samuel Johnson ) ভাষাকে ” The Pedigree of Nations ” হিসেবে বর্ণনা করেন যার অর্থ হচ্ছে , ভাষা জাতির পূর্ব পুরুষদের অর্থাৎ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তাই বলা যায় , নিজের পরিচয় তুলে ধরার জন্য মাতৃভাষা হলো সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম মাতৃভাষার প্রচার প্রসার ভাষাগত বৈচিত্র্য এবংসাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি :

একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা দেয়ার জন্য যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা হলেন , কানাডাপ্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম তাদের প্রতিষ্ঠিতদি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার অভ দ্য ওয়ার্ল্ডসংগঠনের মাধ্যমে ২৯ মার্চ ১৯৯৮ , জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিকমাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করে একটি চিঠি পাঠান এতে সাত জাতি সাত ভাষার দশজন স্বাক্ষর করেন ইউনেস্কোসদর দপ্তর থেকে এপ্রিল৯৯ তারিখের ওই চিঠির জবাবে বলা হয় বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই , ইউনেস্কোর পরিচালনা পরিষদে কোনো সদস্য কর্তৃক রাষ্ট্রের মাধ্যমে তা উত্থাপন হতে হবে রফিকুল ইসলাম আবদুস সালামেরসংগঠনের পক্ষ থেকে তখন বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিপাঠানো হয় কিন্তু আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায়আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ফাইল আটকা পড়লে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে সেপ্টেম্বর ১৭ লাইনের একটিপ্রস্তাব প্যারিসে পাঠানো হয় বাংলাদেশের এই প্রস্তাবের পক্ষে ২৮ টি দেশ লিখিত সমর্থন জানায়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:

জাতিসংঘের শিক্ষা , বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে , বিশ্বের প্রতিটি ভাষার জনগণকেসচেতন করে তোলার জন্যে একটি নির্দিষ্ট তারিখকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হবে বিশ্বের সর্বত্র একইদিনে প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার উন্নতির লক্ষ্যে দিবস পালিত হবে উদ্যোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী কারণ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে , মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া কোনো জাতি জ্ঞানেবিজ্ঞানে বা শিক্ষাদীক্ষায় বড় হতে পারে না তাই প্রতিটি জাতির এবং প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য মাতৃভাষা চর্চা করা ইউনেস্কো তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে , প্রতি বছর একুশেফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা পালন:

১৭ নভেম্বর , ১৯৯৯ সাল প্যারিসে ইউনেস্কোর ৩০ তম কনফারেন্স প্লেনারি সেশনে সর্বসম্মতভাবে ঘোষিত হলো একুশেফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শহিদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষা এতদিনে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভকরলো।বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯১ টি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারী পালিত হচ্ছে।বাংলা ভাষা বাঙালিদের জন্য প্রাপ্তি খুবইমর্যাদার

মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য:

একুশে ফেব্রুয়ারি তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ বিশ্বইতিহাসে অনন্য একটি দিন তাছাড়া আমাদের নিজেদেররাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং সে সংগ্রামে বিজয় অর্জনের উৎসমূলেও রয়েছে এই দিন মাতৃভাষার সঠিক পরিচর্যারঅভাবে বর্তমানে বিশ্বে হাজার ৭০০ টি ভাষার মধ্যে প্রায় হাজার ভাষার নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই আফ্রিকা , এশিয়া , দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশ তাদের নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করছে বিশ্বের দরবারে একটি মাতৃভাষা দিবসথাকায় অনেক ভাষাগোষ্ঠীর তাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সচেষ্ট হবে।

মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার :

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে এবং শিখিয়েছে দিনটির একটি প্রধান শিক্ষা হচ্ছে হাজার রকমেরপ্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের মাতৃভাষা , আমাদের ইতিহাস , ঐতিহ্য কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে দিবস আমাদের আরোশিখিয়েছে অন্য দেশের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করতে আমাদের দিনের অঙ্গীকার বিশ্ববাসীর সঙ্গে এক হয়ে আমাদের মাতৃভাষারগৌরবকে আরো বেশি সমুন্নত রাখা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট :

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য কর্তব্যকে সামনে রেখে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচায় স্থাপিত হয়েছেআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেন , “ বাংলাদেশ নতুন করে প্রমাণ করেছে , মাতৃভাষা হচ্ছে জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য উপাদান সরকারি এক ঘোষণায় জানা যায় , এইইনস্টিটিউট বিশ্বের হাজার ৭০০ ভাষাসহ বিলুপ্ত ভাষাগুলো সংগ্রহ , সংরক্ষণ , চর্চা গবেষণা করবে পাশাপাশি এই কেন্দ্রবাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষা শেখার বন্দোবস্ত করবে

উপসংহার :

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন এবং বিশ্ববাসীর মাতৃভাষা রক্ষার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ারদিন দিন মানবাধিকারের চিরন্তন ধারক বাহক এবং মানুষের মুক্তির চেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করে গড়েতােলার জন্য মাতৃভাষা দিবসের মর্মকথা হলো নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা করা সব নাগরিকের একান্ত কর্তব্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button