আমার প্রিয় খেলা : ক্রিকেট অথবা বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ
ভূমিকা :
ক্রিক্রেটকে বলা হয় খেলার রাজা বা রাজার খেলা । উৎসাহ , উদ্দীপনা ও জনপ্রিয়তায় ক্রীড়াজগতে ক্রিকেটের স্থান সর্বোচ্চে ।আর এর ব্যয় – বাহুল্য ও ক্রীড়া পরিধির দীর্ঘায়িত ব্যাপ্তি একে দিয়েছে রাজকীয় খেলার মর্যাদা । ক্রিকেট খেলায় খেলোয়াড় এবংদর্শকগণ অত্যন্ত উত্তেজনার মধ্যে থাকেন।কারণ গৌরবময় অনিশ্চয়তার এই খেলায় কখন কোন অঘটন ঘটে যায় তা বলা যায়। । তাই টান টান উত্তেজনার ভেতর দিয়ে খেলা চলতে থাকে । আর উত্তেজনায় ভরপুর বলে ক্রিকেট আমার খুবই প্রিয় খেলা ।
ইতিহাস :
ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ড । ইংরেজদের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী শক্তিতে এর উদ্ভব ।তাদের উৎসাহে এর বিকাশ ; তাদের বিশ্বব্যাপীসাম্রাজ্য বিস্তারে এর প্রতিষ্ঠা এবং খেলার উন্নত ক্রীড়শৈলীতে এর শ্রেষ্ঠত্ব । ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের হ্যাম্পবলডনে ক্রিকেটেরপ্রথম দল গড়ে ওঠে । তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটেনে এবং পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে । এক দিনের ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হয় । ১৯৭১সাল থেকে এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে।
খেলার স্থান ও উপকরণ :
ক্রিকেট দুই দলের খেলা । প্রত্যেক দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকে।এ খেলার জন্য একটি সমতল ও বৃত্তাকার মাঠের প্রয়োজন। বৃত্তাকার মাঠের মধ্যস্থলে ২২ গজ সুনির্মিত জমি– ক্রিকেটের ভাষায় একে ‘ পীচ ‘ বলে । পীচের উভয় প্রান্তে তিনটি করে ২৭ ইঞ্চিলম্বা কাষ্ঠ দণ্ড বা স্ট্যাম্প মাটিতে পোঁতা থাকে– একে ‘ উইকেট ‘ বলে । উইকেটের মাথায় দুটি করে ক্ষুদ্র কাষ্ঠ খণ্ড থাকে– একে ‘ বেল ‘ বলে । এক প্রান্তের স্ট্যাম্পের সামনে ব্যাটসম্যান ব্যাট করে এবং অপর প্রান্তে প্রতিপক্ষ বোলার করে বল । ব্যাটসম্যানেরপেছনে থেকে যে বল ধরে তাকে উইকেট রক্ষক ‘ বলে । ব্যাটসম্যান ও উইকেট রক্ষক উভয়ের হাতে পায়ে গ্লাভস ও নরম প্যাডথাকে ।
খেলার নিয়ম :
খেলার নির্ধারিত সময়ের আগে দুজন আম্পায়ার মাঠে এসে পীচের দুই প্রান্তে উইকেটগুলো মাটিতে পুঁতে এর ওপর বেল বসিয়েদেন । এরপর দুই দলের অধিনায়কের উপস্থিতিতে আম্পায়ার টস করেন । টসে নির্ধারণ হয় কোন দল প্রথমে ব্যাটিং করবে এবংকোন দল ফিল্ডিং করবে । যে দল ব্যাটিং করবে তার দুইজন দক্ষ ব্যাটসম্যান ও পেনার হিসেবে ব্যাট করতে এবং প্রতিপক্ষ দলের১১ জন খেলোয়াড় ফিল্ডিং করতে মাঠে নামে । খেলার শুরুতে ফিল্ডিংরত দলের একজন বোলার প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানকেআউট করার জন্য বল নিক্ষেপ করে । বিধি – বহির্ভূত বল হলে নো ও ওয়াইড হয় । পীচে বল পড়ামাত্র উইকেট আড়াল । করেব্যাটসম্যান বলকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করে দূরে পাঠিয়ে দেয় এবং এ সুযোগে দলের সহ – ব্যাটসম্যানের সঙ্গে দৌড়িয়ে অবস্থানপরিবর্তনের মাধ্যমে রান সংগ্রহ করে । বল হলো নানা ধরনের– ফাস্ট , মিডিয়াম ফাস্ট , স্পিন , অফ – স্পিন , গুগলি , ইয়র্কার , ফুলটস , দুসরা , লেগব্রেক , অফব্রেক ইত্যাদি । ব্যাট করার ভঙ্গিও নানা রকম– স্টেট ড্রাইভ , সুইপ , কাট , হুক প্যাডেল সুইপ , ডাউন দ্যা উইকেট ইত্যাদি।ব্যাটসম্যান বল মেরে প্রতিবার স্থান বদল করতে পারলে এক রান অর্জন করে । নির্দিষ্ট সীমানারবাইরে বল পাঠিয়ে দিতে পারলে পায় ৪ রান– এর নাম বাউন্ডারি । ব্যাটের মারের চোটে বল যদি ভূমি স্পর্শ না করে মাঠেরসীমানার বাইরে চলে যায় । তাহলে হয় ওভার বাউন্ডারি , এক্ষেত্রে ব্যাটসম্যান পায় ৬ রান । দলের একজন বোলার প্রতিবার ১ওভার বা ৬ টি বল নিক্ষেপ করে । উইকেট – কীপার ব্যাটসম্যানের পেছনে থেকে বল ধরে । বোলার সবসময় ব্যাটসম্যানকেআউট করার চেষ্টা করে । আর ব্যাটসম্যান উইকেট রক্ষা করে চেষ্টা করে বলকে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে রানের সংখ্যা বৃদ্ধিকরতে । প্রতিপক্ষের ১১ জন খেলোয়াড় মাঠের বিভিন্ন স্থানে শিকারি বাঘের মতো ওঁৎ পেতে থাকে । তারা বলকে সীমানার বাইরেযেতে না দিয়ে রান রক্ষা করে অথবা মাটি স্পর্শ করার আগেই বলটি ধরে ব্যাটসম্যানকে কট আউট করার চেষ্টা করে ।ব্যাটসম্যানের পক্ষে লজ্জাজনক হলো বোল্ড আউট । এছাড়া আছে রান আউট , এলবিডব্লিউ বা লেগ বিফোর উইকেট , স্ট্যাম্পআউট , হিট আউট ইত্যাদি । দুজন আম্পায়ার দু‘প্রান্তে দাঁড়িয়ে বল নিক্ষেপ ও খেলার গতি লক্ষ্য করে । ব্যাটসম্যান আউট হলেআম্পায়ার আঙুল উঠিয়ে নির্দেশ প্রদান করেন । তখন সে ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে ফিরে যায় এবং অপর ব্যাটসম্যান এসে স্থাননেয় । যার বলে ব্যাটসম্যান আউট হয় সেই বোলার সে ব্যাটসম্যানের উইকেট লাভ করে । এভাবে ১০ জন খেলোয়াড় আউটহলে এক পক্ষের ইনিংস শেষ হয় । এরপর অপরপক্ষ প্রথম পক্ষের করা নির্দিষ্ট রানের জবাব দিতে ব্যাট করতে নামে । যদিঅপরপক্ষ প্রথম পক্ষের করা নির্দিষ্ট রান স্পর্শ করার আগে সবাই আউট হয়ে যায় । তাহলে প্রথম পক্ষ খেলায় জয়লাভ করে ।আর যদি প্রথম পক্ষের করা নির্দিষ্ট রান অপরপক্ষের ব্যাটসম্যানরা নির্ধারিত ওভারের মধ্যে করতে পারে তাহলে তারা জয়লাভকরে । আম্পায়ার । এ খেলা পরিচালনা করেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তিন জন ব্যক্তি তাদের ‘ আম্পায়ার ‘ বলা হয় ।আম্পায়ারদের মধ্যে দুজন মাঠে এবং একজন তৃতীয় আম্পায়ার হিসেবে প্যাভিলিয়নে অবস্থান করেন । তিনি সূক্ষ্ম রানআউটগুলো ভিডিও ফুটেজে পর্যবেক্ষণ করে আউট বা নট আউটের সিদ্ধান্ত দেন । ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারের ভূমিকা অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ । আম্পায়ার খেলায় যে সিদ্ধান্ত দেন উভয় পক্ষের খেলোয়াড়দের তা বিনা বাক্য মেনে নিতে হয় । আম্পায়ারগণসাধারণত নিরপেক্ষ থাকেন । তাদের ইঙ্গিতেই খেলা আরম্ভ ও সমাপ্ত হয় ।
ক্রিকেটে অগ্রণী দেশসমূহ :
বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি‘র পূর্ণ সদস্য– অস্ট্রেলিয়া , দক্ষিণ আফ্রিকা , ইংল্যান্ড , নিউজিল্যান্ড , ওয়েস্ট ইন্ডিজ , ভারত , পাকিস্তান , শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ বর্তমানে ক্রিকেট খেলায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে । ইংল্যান্ড , দক্ষিণ আফ্রিকা ওনিউজিল্যান্ড ছাড়া বাকি সবকটি দেশই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মর্যাদার লড়াই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা লাভ করেছে । এছাড়াআইসিসি‘র পূর্ণ সদস্য অপর দুটি দেশ জিম্বাবুয়ে এবং বাংলাদেশও এক দিনের ক্রিকেটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইতোমধ্যেনিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে ।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান :
বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো ক্রিকেট । কারণ খেলাধুলায় বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন ও প্রাপ্তি তারসবটুকুই ক্রিকেটকে নিয়ে । বর্তমানে বাংলাদেশ আইসিসি‘র পূর্ণ সদস্য এবং বিশ্ব ক্রিকেটে দশম টেস্ট প্লেয়িংভুক্ত একটি দেশ ।১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ।বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ওয়ানডে স্ট্যাটাসের জন্য বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্তাআইসিসি‘র কাছে জোর দাবি জানায় । বাংলাদেশ ক্রিকেটের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আইসিসি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশকেওয়ানডে স্ট্যাটাস ‘ প্রদান করে । ১৯৯৯ সাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুবর্ণ সময় । কারণ ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতোস্বপ্নের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নেয় এবং অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে।বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চমকপ্রদ নৈপুণ্যের পর বাংলাদেশক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আইসিসি‘র কাছে জোর দাবি জানায় । এরপর আইসিসি বিভিন্নভাবে বাংলাদেশেরটেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সম্ভাবনা পরীক্ষা – নিরীক্ষা করে । বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবস্থান , জনপ্রিয়তা ও অবকাঠামোগতসম্ভাবনাসহ সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২০০০ সালের ২৬ শে জুন সবগুলো টেস্ট প্লেয়িং দেশের সমর্থনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকেটেস্ট স্ট্যাটাস প্রদান করে । আর টেস্ট স্ট্যাটাসের মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করারজন্য দক্ষ কোচের অধীনে নিবিড় অনুশীলন করতে থাকে । ফলশ্রুতিতে কিছু সাফল্যও আসে । ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে । আর দ্বিতীয় রাউন্ডে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতমশক্তিশালী দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রশংসা অর্জন করে । দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট –২০১১ এর আয়োজকদেশ ছিল বাংলাদেশ , ভারত ও শ্রীলঙ্কা । মোট ৪৯ টি ম্যাচের মধ্যে ৮ টি ম্যাচ বাংলাদেশে অনুষ্টিত হলেও বিশ্বকাপের জমকালোউদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে । ২০১১ বিশ্বকাপ আয়োজনে আয়োজকদের মধ্যে সেরা হয়েছেবাংলাদেশ । বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানের আইসিসি’র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শারদ পাওয়ার বাংলাদেশকেই এবারেরবিশ্বকাপের সেরা আয়োজক হিসেবে উল্লেখ করেন । ২০১৫ অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ অসামান্য ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করে। সাম্প্রতিক অস্ট্রেলীয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ দল ৫ ম্যাচের মধ্যে ৪ ম্যাচে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে।
উপসংহার :
ক্রিকেটে সাফল্যের প্রেরণা কেবল ক্রীড়াঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকে না , তা গোটা জাতিকে এক পতাকা তলে নিয়ে এসে দেশের জন্যকাজ করতে প্রেরণা যোগায় । বিশ্বের বুকে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় , ঘুচে যায় আত্মপরিচয়ের গ্লানি । তাই ক্রিকেট খেলাকেআমাদের আজ আর অবহেলা করার কোনো অবকাশ নেই । বাংলাদেশের সংস্কৃতি , ক্রীড়াঙ্গন তথা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রিকেটেরপ্রভাব হতে পারে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।