আমার প্রিয় শিক্ষক (রচনা)
ভূমিকা :
শিক্ষকতা অত্যন্ত মহৎ পেশা । শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর । একজন শিক্ষক যেমন সকল ছাত্রের কাছে সমানভাবে এখা পাত্র , তেমনি সকল ছাত্রও একজন শিক্ষকের কাছে সমান স্নেহ – করুণার ও মনোযোগের পাত্র । তবে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারবিবেচনার দিক দিয়ে সকল শিক্ষকই ছাত্রদের কাছে সমান শ্রদ্ধেয় হলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হৃদয় গভীরে কোনো একজন শিক্ষকেরপ্রতি একটা প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা সঞ্চিত হতে থাকে । তিনি আস্তে আস্তে হয়ে উঠেন সবার প্রিয় শিক্ষক ।
আমার প্রিয় শিক্ষক যিনি :
আমি আমার ক্ষুদ্র উপলব্ধি দ্বারা বলতে চাই , একজন আদর্শ শিক্ষক তিনি যিনি স্নেহে পিতা , বিপদে বন্ধু , অসংখ্য মানবীয় গুণেগুণান্বিত এবং বিদ্যাদানে অতিশয় দক্ষতাসম্পন্ন । এ ধরনের একজন আদর্শ শিক্ষকই সকল ছাত্র – ছাত্রীর প্রিয় শিক্ষক হতেপারেন । আমি মনে করি , আদর্শ শিক্ষকের উল্লিখিত গুণগুলোর প্রায় সবগুলো গুণই আমাদের বাংলা শিক্ষক জনাব সফিকুররহমানের রয়েছে । তাই তিনি আমার জীবনের অনুসরণীয় শিক্ষক ।
প্রথম পরিচয় :
বিদ্যালয়ের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসে আমি তাঁর ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়েছিলাম । প্রথম ক্লাসটি ছিল পরিচয় পর্বের পরীক্ষায়উত্তম ফলাফলের সুবাদে আমি সহজেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি । কিন্তু প্রথম দিনের আলোচনায় তিনি তাঁর আলোচনার বিষয়ইংরেজির দিকে গেলেন না , তিনি কেবল কিছু কত সম্পর্কে উপদেশ বাণী উচ্চারণ করলেন । আমি বিমুগ্ধ হলাম , আমিঅভিভূত হলাম । অপূর্ব বাচনভঙ্গি , সুনির্বাচিত শব্দাবলির উচ্চারণ আর সহানুভূতিসমৃদ্ধ স্নেহসুধা সবই আচ্ছন্ন করেছিল সেইশ্রেণিকক্ষে সেখানে বিরাজমান ছিল পিন – পতন নীরবতা । আজকের চঞ্চল আর বিচিত্র যুবসমাজকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার কিঅপরিসীম ক্ষমতা সেই কণ্ঠস্বরে । পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ঝঙ্কৃত ঘন্টাধ্বনি যেন খুব দ্রুত শুনতে পেলাম । সেই থেকে দু‘বছর তিনিআমাদের জীবনটাকে যেন কানায় কানায় ভরে তুললেন ।
কেন আমার নিকট প্রিয় হলেন :
অনেক আদর্শ শিক্ষকের সাহচর্য পেলেও সফিকুর স্যারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ছাত্রদের প্রতি আন্ত রিক ভালোবাসা আমাকেতাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছে । তিনিই শ্রেণিকক্ষের নীরস পরিবেশটিকে স্নেহ দিয়ে , শাসন দিয়ে সরস করে তুলেছেন । অনেকশিক্ষকের ক্লাসেই আমি খুব ক্লান্তি অনুভব করি এবং শ্রেণিকক্ষটিকে কারাগারের মতো মনে হয় । অথচ তার ক্লাসগুলোবিনোদনের মতো আমার নিকট মনে হয় এবং আমি কখনো তাঁর ক্লাস করে ক্লান্তিবোধ করি না । দেশের সমস্ত শিক্ষক যদি তারমতো হাস্যরসিক ও শিক্ষাদানে পারদর্শী হতেন , তবে কোনো ছাত্র – ছাত্রীর নিকটই লেখাপড়া কঠিন বলে মনে হতো না । তাঁরসময়নিষ্ঠা , নিয়মানুবর্তিতা , স্পষ্টবাদিতা তাঁকে ছাত্রদের প্রিয় করে তুলেছে । আমি প্রায়ই চিন্তা করি , তিনি যদি শিক্ষাদানেরমাঝে আনন্দ না দিয়ে শুধু বেত্রাঘাত ও কাজের উপদেশ দিতেন তবে তিনি অবশ্যই বর্তমানের মতো জনপ্রিয় হতে পারতেন না ।কথায় বলে শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে । অক্ষরে অক্ষরে এ বাক্যটি তার ক্ষেত্রে সত্যি । প্রয়োজনে তিনি কঠোরশাস্তি দেন আবার পরক্ষণে আমাদেরকে বুকে টেনে নেন । আমাদের যেকোন সমস্যাকে নিজ সমস্যা মনে করে তিনি এগিয়েআসেন । বিদ্যালয়ে সকলেই তার ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতায় প্রশংসিত । তার বাচনভঙ্গি ও পাঠ বুঝাবার কৌশল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। জনাব সফিকুর রহমান স্যারের মধ্যে মানব চরিত্রের দোষ – ক্রটি একেবারে নেই এমন নয় । তবে তিনি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তাসংযত রাখতে চেষ্টা করেন ।
আদর্শ ব্যক্তিত্ব :
সফিকুর স্যারের ব্যক্তিত্বের আদর্শে আমরা প্রেরণা লাভ করেছি অফুরন্তভাবে । তার ব্যক্তিত্ব কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বইয়ের পাতার কাল অক্ষরে তাঁর দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে থাকেনি , তিনি চারপাশের জীবনকে প্রত্যক্ষ করতেন এবং সেখানে তার মহানব্যক্তিত্বের আলোয় – আলোকিত করে তোলার প্রয়াস পেতেন । শৃঙ্খলাকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দান করতেন । সুআচরণকে তিনিসভ্যতা – সংস্কৃতির প্রকাশ বিবেচনা করতেন । সততা ও আন্তরিকতাকে তিনি জীবনের সাফল্যের উপায় ভাবতেন ।সময়ানুবর্তিতাকে তিনি মনে করতেন জীবন গঠনে অনিবার্য বান্ধব । বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তাঁর আদর্শ ব্যক্তিত্বের এ ধরনেরঅনুশীলন পরিবেশকে পাঠের যথার্থ অনুকুল করে তুলেছিল । শ্রেণিকক্ষে প্রায় সবাইকে তিনি নাম ধরে ডাকতেন , কিন্তু পরীক্ষারহলে আমাদের চিনতেন না । একটি অসদাচরণমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি যে ভূমিকা গ্রহণ করতেন তা আমাদেরমনে ভীতি নয়— পরম শ্রদ্ধার উদ্রেক করত । তার এ ধরনের কর্তব্যপরায়ণতা তাকে আমার কাছে অধিকতর প্রিয় করে তুলেছে।
অনুভূতি প্রবণতা :
একটি অনুভূতিশীল হৃদয়ের প্রকাশ হয়েছিল তাঁর উদার বুকের মধ্যে । কোনো শিক্ষার্থীর ম্লান মুখ তাকে বেদনাকাতর করে তুলত। কারো দীর্ঘদিন অনুপস্থিতি তার মনোবেদনার কারণ হতো। কারো পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হলে তিনি উদ্বিগ্ন হতেন ।কারো উদ্ধত আচরণে তিনি মর্মাহত বা ক্রোধান্বিত কোনোটাই হতেন না । তবে তিনি এ সবকিছুরই কারণ অনুসন্ধান করতেনএবং তার নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন । ভালো ফলাফলের নমুনা দেখে তিনি উল্লসিত হতেন এবং উদারভাবে প্রশংসাকরে নিজের আনন্দানুভূতি ব্যক্ত করতেন । শিষ্যের কাছে পরাজিত হওয়ার সাধনা তার সকল প্রচেষ্টায় বিদ্যমান ছিল । পরাজিতহওয়াতে তিনি গৌরব বোধ করতেন । সবার সঙ্গে তাঁর মার্জিত আচরণ , তাঁর অকৃত্রিম সৌজন্যবোধ , তাঁর কুশলাদি বিনিময়– এসবকিছুই ছিল অনুসরণযোগ্য । জীবনকে সুন্দর করার জন্য এসব উপকরণ আমাদের কাছে মূল্যবান সম্পদ ।
উপসংহার:
আমি আমার প্রিয় ও আদর্শবান শিক্ষকের কাছে যা শিখলাম ও জানলাম তা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । বাংলাদেশেরসকল শিক্ষকই যদি তাঁর মতো আদর্শ ও আঁটি মনের অধিকারী হতেন তা হলে এদেশের শিক্ষার মান আরো অনেক স্মত হতো।এমন চরিত্রের শিক্ষককে ছাত্র – ছাত্রীরা ভুলতে পারে না । আমার বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে আমি সমভাবে শ্রদ্ধা করি তবুওকিছু বিশেষ গুণ ও আচরণের জন্য আমাদের বাংলা শিক্ষক জনাব সফিকুর রহমান আমার অতি প্রিয় ব্যক্তি বিশেষভাবেশ্রদ্ধাভাজন ও আপনজনদের মধ্যে একজন হয়েছেন । সর্বোপরি তিনিই আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক।