বাংলা রচনা সমগ্র

আর্সেনিক দূষণ ও তার প্রতিকার

ভূমিকা :

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম সমস্যাবহুল দেশ এসব সমস্যার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আর্সেনিক দূষণ আর্সেনিকসমস্যা একটি প্রাকৃতিক সমস্যা বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের ফলে বর্তমানে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষআর্সেনিক দূষণের শিকার এদেশের মানুষের জীবন আর্সেনিক দূষণের কারণে বিপন্ন প্রায় দিন দিন আর্সেনিক দূষণেরপরিমাণ বেড়েই চলেছে ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ অকাল মৃত্যুর প্রহর গুণে চলেছে এজন্য আর্সেনিক দূষণ থেকে মানুষেরজীবন রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই

আর্সেনিক দূষণ কী :

আর্সেনিক একটি স্বাদহীন ভঙ্গুর মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থ এর রং ধূসর বা রূপালি এটি একটি দানাদার পদার্থ বিশেষ , যাবায়ুর সংস্পর্শে আসলে কালো রং ধারণ করে প্রাকৃতিক উপায়ে আর্সেনিক মাটি , বায়ু পানিতে বিভিন্নরূপে অবস্থান করে আর্সেনিক যখন পানিতে দ্রবীভূত হয় তখণ এর কোনো বর্ণ , গন্ধ বা স্বাদ থাকে না তাই আর্সেনিকযুক্ত পানিকে বিশুদ্ধ পানিথেকে আলাদা করা যায় না মূলত ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগের লক্ষণসমূহ :

আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর তিনটি পর্যায় রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত রোগীর গায়ে কালো কালো দাগ দেখা যায় দ্বিতীয়পর্যায়ে রোগীর হাতের পায়ের তালুর চামড়া খসখসে হয়ে যায় তৃতীয় পর্যায়ে হাত পায়ে গুটি গুটি দেখা যায় এবং পরবর্তীসময়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে , আর্সেনিক কোনো জীবাণুবাহিত রোগ হয় কাজেই রোগছোঁয়াচে কিংবা বংশগত কোনো রোগ   নয়

বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যার বিস্তৃতি :

বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যা একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক সমস্যা বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরচাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বারোঘরিয়া ইউনিয়নে নলকূপের পানিতে প্রথম আর্সেনিকের দূষণ চিহ্নিত করে বাংলাদেশ আণবিকশক্তি কমিশনের পরীক্ষাগারে এই আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয় যদিও ১৯৯৩ সালে নলকূপের পানিতে আর্সেনিক দূষণ পাওয়াযায় , তবুও ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এর দূষণ মাত্রা আক্রান্ত এলাকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়নি মূলত , ব্যাপকভাবে নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পরীক্ষার যন্ত্রপাতির অভাবে এই কাজ ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়নি ইউনিসেফ এবংব্রিটিশ ডিএফআইডিএর সহায়তায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দুটি সমীক্ষা পরিচালনা করে বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতেআর্সেনিক দূষণ মাত্রার একটি চিত্র পায় দেশব্যাপী মোট ৫৩ হাজার নলকূপের পানি পরীক্ষা করে দুটি সমীক্ষার ফলাফলেদেখা যায় যে , দেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৫৯ টি জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক রয়েছে তবে নলকূপের পানিতে দূষণমাত্রাএলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন এই দুটি সমীক্ষায় ৫৯ টি জেলার ২৬৮ টি উপজেলায় আর্সেনিক দূষণ পাওয়া গেছে দেশব্যাপী মোটপরীক্ষিত নলকূপের মধ্যে ২৮ % নলকূপের পানিতে আর্সেনিক দূষণ গ্রহণসীমার উর্ধ্বে পাওয়া গেছে এই দূষণ মূলত দেশেরঅগভীর নলকূপে পাওয়া গেছে সরকারি বেসরকারি জরিপানুযায়ী বর্তমানে দেশের কোটিরও অধিক মানুষ আর্সেনিকদূষণের আওতায় পড়েছে সম্প্রতি ইউনিসেফের আর্থিক সাহায্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের একটি জরিপের মাধ্যমেদেখা গেছে , দেশের মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত এলাকা আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত বৃহত্তর সিলেটেও আর্সেনিকের লক্ষণ বর্তমান দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে আর্সেনিকে আক্রান্তহওয়ার নজির রয়েছে

আর্সেনিক প্রতিরোধ প্রতিকারের উপায় :

আর্সেনিক দূষণ একদিনে সৃষ্টি হয়নি এজন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি গ্রহণ করে এর প্রতিকার প্রতিরোধ করতে হবে আর্সেনিকসমস্যার একমাত্র সমাধান হলো বিশুদ্ধ পানি তথা আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ আর্সেনিক দূষিত পানি বিশুদ্ধ করার জন্যভারতের পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এক ধরনের ফিল্টার ট্যাবলেট তৈরি করা হয়েছে এটি বেশ ফলপ্রসূ ২০লিটার পানিতে ৫০০ গ্রাম ফিটকিরি দিয়েও পানি বিশুদ্ধ করা যায় আর্সেনিক দূষণ প্রতিরােধের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণকরা যেতে পারে :

. আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে হবে

. ভূগর্ভস্থ পানি মাটি পরীক্ষা করে নিরাপদ স্থানে নলকূপ বসাতে হবে

, আর্সেনিক পরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে আর্সেনিক দূষণের সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিত করতে হবে।

. নদীনালা খালবিলের পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে

. আর্সেনিকযুক্ত পানি চিহ্নিত করতে হবে এবং সে পানি পান করা বন্ধ করতে হবে

. আর্সেনিকযুক্ত পানি ওষুধ বা ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করতে হবে।

. আর্সেনিকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।

. জেলা পর্যায়ে পানি পরীক্ষা শোধনাগার স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে

চিকিৎসা:

প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে আর্সেনিক দূষিত পানি খাওয়া বন্ধ করে দিলে রোগী আপনাআপনিই ভালো হয়ে যায় ডিপেনিসিলামিন ২৫০ মিলিগ্রাম তিনবার চার মাস ব্যবহারে ভালোফল পাওয়া যায় এছাড়াও ভিটামিন ‘ , ভিটামিন ‘ , ভিটামিন সি উচ্চ পুষ্টিকর খাবারে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় সবুজ শৈবাল দিয়ে তৈরি শুরুলিনা নামক ওষুধ কার্যকরবলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক চিকিৎসক , যদিও আর্সেনিকের কোনো কার্যকর চিকিৎসাই অদ্যাবধি আবিষ্কারহয়নি।

উপসংহার :

আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার বিষয়টি ক্রমান্বয়ে জটিল আকার ধারণ করছে বিষয়টি এখন বিরাট চ্যালেঞ্জেরসম্মুখীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের সকল নলকূপের পানি পরীক্ষার মাধ্যমে আর্সেনিক যুক্ত বা মুক্তনলকূপ চিহ্নিত করা এবং ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতির কারণ খুঁজে বের করে এর নিরসনের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমস্যা কবলিত এলাকার জন্য নিরাপদ পানির উৎস চিহ্নিত করে জনগণের কাছে তা গ্রহণ যোগ্য সহজ রক্ষণাবেক্ষণের প্রযুক্তিপ্রদানের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button