বই রিভিউ: উভচর মানুষ – আলেক্সান্দর বেলায়েভ (বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র)

Uvohor Manush by Alexandra belayev book review in bangla:
বইয়ের নাম |
উভচর মানুষ |
অনুবাদক |
ননী ভৌমিক |
প্রকাশক |
বিশ্বসাহিত্য কেন্ |
পেজ |
176 |
দেশ |
বাংলাদেশ |
ভাষা |
বাংলা |
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে বইটি অনুবাদ করা হয়েছে। তাই কাগজ ও অনুবাদ বেশ ভালো ছিলো। উপন্যাসটি আমার কাছে বেশভালোই লেগেছে।
একজন মানুষকে একজন বিজ্ঞানী এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, সে জলে ও স্থলে সমানভাবে বাস করতে সক্ষম। উপন্যাস যারাভালোবাসে তারাই পড়তে মজা পাবে।ননী ভৌমিকের ‘উভচর মানুষ’-এর অনুবাদ পড়ে আমি বলতে বাধ্য অনুবাদটি অনেকভালো, পড়ে মনেই হয়নি এটা অনুবাদ, মনে হয়েছিল এটাই আসল বই।
কাহিনীটা মূলত ইকথিয়ান্ডর নামক এক যুবকের। সমুদ্রের নাবিকরা তাকে ডাকে – ‘দরিয়ার দানো’ নামে। ’দরিয়ার দানো’ ওরফেইকথিয়ান্ডর আসলে একজন উভচর মানুষ। প্রফেসর সালভাতর তাকে উভচর মানুষে পরিণত করেছে। সে মাটির চেয়ে পানিতেথাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কিন্তু একদিন সে গুত্তিয়েরে নামক এক মেয়ের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তার রূপ দেখে প্রেমে পড়ে যায়।এরপর গুত্তিয়েরের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু একদিন সে জানতে পারে জুরিতার সাথে গুত্তিয়েরের বিয়ে হয়ে গেছে। এদিকেজুরিতাও ইকথিয়ান্ডরকে ধরতে চায় যেন সে পানির নিচ থেকে মুক্তা এনে দেয়। গুত্তিয়েরেকে জুরিতার কাছ থেকে বাঁচাতে গিয়ে সেজুরিতার কাছে ধরা পড়ে। তবে শেষে সালভাতর তাকে বাঁচায়। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সবাই জেনে যায় ইকথিয়ান্ডরেরকথা। তার জীবনে তখন এক নতুন মোড় নেয়।
আলেক্সান্দর বেলায়েভ ও উভচর মানুষ বই রিভিউ
জেলেদের মুখে মুখে কেবলই দরিয়ার দানো’র কথা : দরিয়ার দানো দেখা দিয়েছে সমুদ্রের খাড়িতে । ডলফিনের পিঠে চেপে সেছোটে , শঙ্খ বাজিয়ে নিজের আগমন জানায় । জাল টেনে নিয়ে যায় , জাহাজ – ভর্তি মাছ ছেড়ে দেয় , কখনো কখনো উদ্ধার করেডুবন্তদের … কী সেই বিস্ময়ের জন্তু দরিয়ার দানো ’ , যে জলে আর ডাঙায় খুব সহজেই চরে বেড়ায় ! রুশ কল্প – বিজ্ঞানের পথিকৃৎআলেক্সান্দর বেলায়েভের এক অপরূপ সৃষ্টি দুর্দান্ত তরুণ ইকথিয়ান্ডর বা মৎস্যকুমার ‘ । সমুদ্রতলের অফুরান জগৎকে জানারএবং মানুষের বাস করার স্বপ্ন দেখেছেন লেখক । উপন্যাসে ড . সালভাতরকে দিয়ে তা অনেকটা বাস্তব বলে প্রমাণের চেষ্টাওকরেছেন ।
লেখকের ধারণা ছিল , মানুষ মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার প্রথম দিকে জলে – ডাঙায় দু’জায়গাতেই অবাধে বিচরণ করত । তখনমানুষ ছিল উভচর । এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই লেখক এই বিখ্যাত উপন্যাসটি লিখেছেন । বেলায়েভের এ ধারণা যে ভ্রান্ত নয়তা মাত্র এক দশক আগে ড . মরগ্যানের এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে । ব্রিটেনের বিজ্ঞানী ড . এ্যালাইনমরগান তার তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন— এখন যেখানে আফ্রিকা মহাদেশ ত্রিশ থেকে নব্বই লক্ষ বছর আগে সেখানে সমুদ্রঘেরা ছোটছোট দ্বীপপুঞ্জ ছিল । তুষারযুগের শেষে বরফ যখন গলতে থাকে তখন অনেক স্থলভাগই সমুদ্র গ্রাস করে নিয়েছিল এবং অনেকজায়গায় খুব ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি হয়েছিল । বনমানুষদের মধ্যে যারা এসব দ্বীপে আটকে পড়েছিল , তাদের বিবর্তন হতেলাগল একটু ভিন্নভাবে । ব্যাঙ আর কুমিরদের মতো এরাও হয়ে উঠল উভচর প্রাণী । ড . মরগানের এ তত্ত্ব সম্পর্কে লেখকজানতেন না কিন্তু তাঁর বিজ্ঞানপ্রসূত চিন্তা – চেতনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক কল্পনার উভচর মানুষ ।
খুব ছোটবেলা থেকেই বেলায়েভের ঝোক নানা রঙের স্বপ্ন দেখার প্রতি । লেখকের ইচ্ছে হত মানুষ পাখির মতো উড়ুক । চেষ্টা করেদেখতে গিয়ে ছাদ থেকে লাফ দিলেন , মেরুদণ্ড ভাঙল তাঁর । তিনি ভেবেছিলেন ওটা সেরে গেছে । কিন্তু বত্রিশ বছর বয়সে দেখাদিল অস্থি’র ক্ষয় – রোগ । সারাটা জীবন এই কাল – ব্যাধি তাঁকে ছাড়েনি । যারা যান তিনি ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে । বছরেরপর বছর শয্যাশায়ী থাকলেও দুর্দমনীয় এই জীবনবাদী মানুষটি অনেক অনেক বই লিখে গেছেন , রোমান্টিক কল্পনা আরবৈজ্ঞানিক দুঃসাহসে যা স্পর্ধিত ।
আলেক্সান্দর বেলায়েভের জন্ম ১৮৮৪ সালে । আইন এবং সংগীতের ছাত্র ছিলেন ‘ তিনি । অসচ্ছল সংসার এবং লেখাপড়ারখরচ মেটানোর জন্য বেলায়েভ বাজনা বাজাতেন অর্কেস্ট্রায় , রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপট আঁকতেন , সাংবাদিকতা করতেন । আইনবিদহওয়ার পরেও এই শেষ পেশাটি তিনি ছাড়েননি । ১৯২৫ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন সাহিত্যে । ১৯২৬সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্লোপন্যাস প্রফেসর ডডায়েলের মস্তক । খুব দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে পড়েন তিনি । এরপরএকে একে উভচর মানুষ ’ , ‘ জাহাজডুবির দ্বীপ ’ , ‘ শূন্যে ঝাপ ’ ইত্যাদি বই প্রকাশিত হয় । চিকিৎসাবিদ্যা , জীববিদ্যা , পদার্থবিদ্যা , মহাকাশ অভিযানের নানা সমস্যা নিয়ে অর্ধশতাধিক বই লিখে গেছেন তিনি , যেগুলো বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের কাছেআজও সমাদৃত ।
রবিশঙ্কর মৈত্র
দরিয়ার দানো
জানুয়ারিতে আর্জেন্টিনার গ্রীষ্মের গুমোট রাত । কালো আকাশ ছেয়ে গেছে তারায় । শান্তভাবে নোঙর ফেলে আছে ‘ জেলি – মাছ ‘ জাহাজ । জলের ছলাৎ বা মাস্তুলের কোচকাচানি কিছুই নেই , নিঝুম রাত । মনে হয় গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে মহাসাগর ।ডেকে শুয়ে আছে অর্ধনগ্ন মুক্তো – সন্ধানীরা । কাজের চাপ ও প্রচণ্ড রোদে অবসন্ন তারা ঘুমের মধ্যেই এপাশ – ওপাশ করছে , চেঁচিয়ে উঠছে । থেকে থেকে চমকে উঠছে । হাত – পা । স্বপ্নে হয়তো দেখেছে তাদের দুশমন কোনো হাঙর । নির্বাত এই তপ্তদিনগুলোয় ওরা এতই ক্লান্ত যে নৌকাগুলোকে ও ডেকে তোলেনি । তবে তার দরকারও ছিল না , আবহাওয়া বদলাবার কোনোলক্ষণ দেখা যায় নি , নোঙরের শেকলে বেঁধে তাদের জলেই রেখে দেওয়া হয়েছে । পালটাল কিছুই কষে বাঁধা হয়নি , সামান্যবাতাসেই তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠছে সামনের মাস্তুলের তেকোনা পালটা । ডেকের প্রায় সবটা জুড়ে ঝিনুকের স্থূপ , ভাঙা প্রবালেরচুনাপাথর , ডুবুরির দড়ি , ঝিনুক জমাবার ক্যানভাসের বস্তা আর ফাকা পিপে ছড়ানো । মিজেন মাস্তুলের কাছে ছিল একটাপানীয় জলের প্রকাণ্ড পিপে , তাতে শেকলে বাঁধা একটা লোহার মগ । পিপেটার আশেপাশে জল পড়ে কালো দাগ ফুটেছে । থেকেথেকেই এক – একজন ডুবুরি উঠে আধ – ঘুমে টলতে টলতে ঘুমন্তদের মাড়িয়ে জল খাবার জন্য যাচ্ছিল পিপেটার কাছে । চোখবুজেই এক মগ জল খেয়ে যেখানে পারছিল লুটিয়ে পড়ছিল , যেন জল নয় কড়া মদ খেয়েছে ।
তৃষ্ণায় এরা সবাই পীড়িত । সকালে কাজে যাবার আগে এরা খেত না , ভরা পেটে জলের তলে চাপ পড়ে ভয়ানক বেশি , জলেরতলে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত সারা দিন খালি পেটে থেকে খাওয়া সারত কেবল ঘুমের আগে । আর সে খাদ্যও ছিল নোনা মাংস। রাতে ডিউটি দিচ্ছিল রেড – ইন্ডিয়ান বালতাজার । জাহাজের মালিক ক্যাপটেন পেদ্রো জুরিতার ডান হাত ছিল সে জোয়ানকালে বালতাজারের নাম ছিল মুক্তো সংগ্রহের জন্য । জলের নিচে সে থাকতে পারত নব্বই কি একশ ’ সেকেন্ড সাধারণ ডুবুরিরতুলনায় সময়টা দ্বিগুণ । ‘ কেমন করে ? কেননা আমাদের কালে এ বিদ্যে কী করে শেখাতে হয় তা লোকে জানত আর শেখানোশুরু হত একেবারে ছেলেবেলা থেকেই’– জোয়ান ডুবুরিদের বলত বালতাজার । আমার বয়স যখন দশ , তখন বাবা আমায়শেখাতে পাঠায় হোসের কাছে , পালতােলাূ একটা জাহাজ ছিল তার । চেলা ছিল তার বারোজন । করত কী , জলে একটাসাদা ঢিল কি ঝিনুক ছুড়ে দিয়ে বলত : তুলে নিয়ে আয় ! প্রতিবার ছুড়ত আরেকটু বেশি গভীরে ।
না পারলে দু‘এক ঘা চাবুক কষে কুকুর ছোড়ার মতো করে ছুড়ে ফেলত : ‘ ফের : তুলে আন ! ‘ এভাবেই শেখাত আমাদের ।তারপর শেখাতে লাগল কীভাবে জলের তলে থাকতে পারি বেশিক্ষণ । পাকা ডুবুরি জলে নেমে গিয়ে নোঙরের সঙ্গে ঝুড়ি কিজাল বেঁধে রাখত । পরে ডুব দিয়ে তা খুলতে হত আমাদের । না খোলা পর্যন্ত উপরে ওঠা চলবে না । উঠলেই বেত । মারতআমাদের মায়াদয়া না করে । অনেকেই টিকতে পারেনি । তবে এলাকার পয়লা নম্বরের ডুবুরি হয়ে উঠি আমি ।
ভালোই রোজগার করতাম । বয়স হতে বিপজ্জনক পেশাটা তাকে ছাড়তে হয় । বা পাটা তার হাঙরের কামড়ে বিকৃত হয়ে যায় ।পাশটা হেঁচড়ে যায় নোঙরের শেকলে । বুয়েনাস – আইরেসে তার একটা ছোট দোকান ছিল । মুক্তো , প্রবাল , ঝিনুক আরসামুদ্রিক নানা বিরল দ্রব্যের ব্যবসা করত সে । কিন্তু ডাঙায় তার মন লাগত না । তাই প্রায়ই মুক্তো সংগ্রহের অভিযানে যোগ দিত। কারবারিরা কদর করত ওকে । লা – প্লাতা উপসাগর , তার উপকূল , কোন্ কোন্ জায়গায় মুক্তো পাওয়া যায় তা ওর মতো আরকেউ জানত না । ডুবুরিরাও সম্মান করত তাকে ।
ডুবুরি , মালিক— সবাইকেই খুশি রাখতে পারত সে । তরুণ ডুবুরিদের সে পেশাটার আঁঘাৎ শেখাত — কী করে দম রাখতে হয় , ঠেকাতে হয় হাঙরের আক্রমণ এবং মেজাজ শরিফ থাকলে , কর্তার কাছ থেকে কোনো একটা দামি মুক্তা লুকিয়ে রাখতে হয়কীভাবে সেটাও । মনিবেরা তার কদর করত এই জন্য যে এক নজরেই সে মুক্তার সঠিক দাম বলে দিত , সেরা মুক্তা বেছে দিতেপারত । সেই জন্যই সহকারী হিসেবে মনিবেরা তাকে সঙ্গে নিত সাগ্রহেই । একটা পিপের উপর বসে বসে মোটা একটা চুরুটটানছিল বালতাজার । মাস্তুলে ঝোলানো একটা লণ্ঠন থেকে আলো পড়ছিল তার মুখে । মুখখানা তার লম্বাটে , গালের হাড় উচুনয় , তরতরে নাক , সুন্দর চোখ টিপিক্যাল আরাউকানি রেড ইন্ডিয়ানের মুখ । বালতাজারের চোখের পাতা ঢুলে আসছিল ।
কিন্তু চোখ তার ঘুমলেও কান নয় । সজাগ তার দুই কান গভীর ঘুমের মধ্যেও বিপদের আঁচ পায় । কিন্তু এখন বালতাজারশুনছিল কেবল ঘুমোন্তদের নিশ্বাস ফেলার শব্দ আর অস্ফুট বিড়বিড়ানি । তীর থেকে ভেসে আসছিল ঝিনুকের পচা গন্ধ— ঝিনুকগুলোকে প্রথমে পচতে দেওয়া হয় , তাতে খোলা I ছাড়ানো সহজ হয় । অনভ্যস্ত লোকের কাছে গন্ধটা অসহ্য ঠেকবে , কিন্তুবালতাজারের কাছে বোধ হয় তা উপাদেয়ই লাগে ।
মুক্তা বাছাইয়ের পর বড় বড় ঝিনুকগুলো নিয়ে আসা হয় জাহাজে । জুরিতা হিসেবি লোক , ঝিনুক সে বেচে দিত কারখানায় , তাথেকে বোতাম তৈরি হত । ঘুমাচ্ছিল বালতাজার , শিথিল আঙুল থেকে খসে পড়ল চুরুট । মাথা নুয়ে পড়ল বুকের উপর । কিন্তুচেতনায় ওর কী একটা শব্দ এসে পৌছল সুদূর থেকে । শব্দটা আবার হল একটু কাছে । চোখ মেলল বালতাজার । মনে হল কেযেন শাঁখ বাজাল , মানুষের মতো একটা তরুণ কণ্ঠস্বর বলে উঠল ‘ আ– ! ‘ তারপর ফের আরেকটু চড়ায় ‘ আ – আ ! শখেরসুরেলা শব্দটা মোটেই জাহাজের খনখনে বাঁশির মতো নয় , গলার আওয়াজটাও এমন নয় যেন ডুবন্ত মানুষ সাহায্য চাইছে ।কেমন একটা নতুন , অজানা আমেজ তাতে । উঠে দাঁড়াল বালতাজার , সঙ্গে সঙ্গেই চাঙ্গা হয়ে উঠল । ধারে গিয়ে তীক্ষ দৃষ্টিতেচাইল 1 সমুদ্রে । কোনো লোক নেই কোথাও ।
পা দিয়ে সে খোচাল একজন ঘুমন্ত রেড ইন্ডিয়ানকে । ‘ চেঁচাচ্ছে । নিশ্চয় ও – ই … ‘ কই শুনছি না তোসমান আস্তেই বললগুরোনা জাতের রেড ইন্ডিয়ানটা , হাঁটু গেড়ে সে কান পেতে ছিল । হঠাৎ নীরবতা ভেঙে পড়ল শাঁখের শব্দ আর চিৎকারে ; । ‘ আআ ! … ‘ শুনেই গুরোনা কুঁকড়ে গেল , যেন রেতের ঘা খেয়েছে । হ্যা , নিশ্চয় ও – ই’– ভয়ে দাঁত ঠকঠক করে বলল গুরোনা ।অন্য ডুবুরিরাও জেগে উঠল । হেঁচড়ে গেল তারা লণ্ঠনের আলোটার দিকে , যেন অন্ধকার থেকে ওই হলদেটে ক্ষীণ আলোটাইতাদের বাঁচাবে । উদগ্রীব হয়ে কান পেতে বসে রইল সবাই ঘেঁষাঘেঁষি করে । শখ আর গলার আওয়াজ আরেকবার শোনা গেলঅনেক দূরে , তারপর মিলিয়ে গেল । ‘ ও – ই … ‘ ‘ দরিয়ার দানো’– ফিসফিস করল জেলেরা ।
‘ এখানে আর আমাদের থাকা চলে না ! ’ ‘ হাঙরের চেয়েও ও সাঙ্ঘাতিক ! ‘ কর্তাকে ডাকা হোক ! খালি পায়ের খসখসানি উঠল। হাই তুলতে তুলতে , রোমশ বুকে হাত বুলাতে বুলাতে । ডেকে এসে দাঁড়াল মনিব পেদ্রো জুরিতা । গায়ে জামা নেই , পরনেক্যানভাস প্যান্ট , বেল্ট থেকে ঝুলছে রিভলবারের খাপ । লোকগুলা দিকে এগিয়ে এল সে । আলো পড়ল তার ঘুম – ঘুমবোদপোড়া ব্রোঞ্জরঙা মুখে , কপালের উপর এসে পড়া কোঁকড়া – ঝাঁকড়া চুলে , কালো ভুরু , উপর দিকে একটু তোলা মোচ আরপাক ছাগলদারির ওপর ।
হল – টা কী ? তার কর্কশ , অবিচল কণ্ঠস্বর আর সুনিশ্চিত দেহভঙ্গিতে শান্ত হয়ে এল রেড ইন্ডিয়ানরা । একসঙ্গেই কথা বলতেশুরু করল সবাই । হাত তুলে ওদের থামিয়ে বালতাজার বলল : ‘ আমরা ওর আওয়াজ শুনলাম , দরিয়ার দানোর । ‘ স্বপ্ন ! দ্রিালুভাবে মাথা নেতিয়ে বলল পেদ্রো । না , স্বপ্ন নয় , সবাই আমরা “ আ– ! ” হাঁক আর শাঁখের আওয়াজ শুনেছি ! ‘ সমস্বরেবলে উঠল ডুবুরিরা । হাত তুলে ফের ওদের থামিয়ে বালতাজার বলল : ‘ আমি নিজে শুনেছি । ওভাবে শাঁখ বাজাতে পারে কেবল‘ দানো ’ । সমুদ্রে ওভাবে কেউ শাঁখও বাজায় না , হাঁকও দেয় না । শিগগির এখান থেকে সরে পড়া দরকার । ‘ গাঁজাখুরি’– সমানআলস্যে জবাব দিল পেদ্রো । তীরে এখনো ঝিনুকগুলো সব পুরো পচে ওঠেনি । সেগুলো জাহাজে এনে নোঙর তোলার কোনোইচ্ছেই ছিল না তার । কিন্তু ডুবুরিদের বোঝানো গেল না । উত্তেজিত হয়ে উঠল তারা , হাত নেড়ে চেঁচাতে লাগল , হুমকি দিলজাহাজ না ছাড়লে কালই তারা তীরে গিয়ে পায়ে হেঁটে বুয়েনাস – আইরেসে রওনা দেবে । “
ঠিক আছে , চুলায় যা তারা আর তোদের এই “ দাননা ” ! কাল ভোরেই নোঙর তোলা হবে’– বলে গজ গজ করতে করতেক্যাপটেন চলে গেল তার কেবিনে । ঘুম তার টুটে গিয়েছিল । বাতি জ্বালিয়ে চুরুট ধরিয়ে সে ছোট কেবিনটায় পায়চারি শুরু করল। এই যে দুর্বোধ্য একটা প্রাণী অল্প কিছুদিন হল এখানকার সাগরে দেখা দিয়েছে , ডুবুরিদের আর উপকূলের বাসিন্দাদের ভয়পাওয়াচ্ছে , তারই কথা ভাবছিল সে । কেউ তাকে দেখেনি , সে কিন্তু তার জানানি দিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার ।
কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে তাকে নিয়ে । ফিসফিস করে তা বলাবলি করত নাবিকেরা , চারপাশে 1 তাকাত ভয়ে ভয়ে যাতে কথাগুলোদানোর কানে না যায় । প্রাণীটা কারো – বা ক্ষতি করেছে , আবার অপ্রত্যাশিত উপকারও করেছে কারো কারো । বুড়ো রেড – ইন্ডিয়ানরা বলত , উনি সমুদ্রের দেবতা , হাজার বছরে একবার করে উনি সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসেন দুনিয়ায় ন্যায়ের রাজ্যপ্রতিষ্ঠার জন্যে । ক্যাথলিক পাদ্রিরা সংস্কারাচ্ছন্ন স্পেনীয়দের বােঝাত , ওটা দরিয়ার দানো ’ । লোকে পবিত্র ক্যাথলিক গির্জাকেভুলে যাচ্ছে বলে ও দেখা দিতে শুরু করেছে । মুখে মুখে ছড়ানো এইসব গুজব বুয়েনাস – আইরেস পর্যন্ত পৌছয় । কয়েক সপ্তাহধরে ‘ দরিয়ার দানো ’ হয়ে উঠল বাজারি কাগজগুলোর প্রিয় প্রসঙ্গ ।
অজ্ঞাত কারণে কোনো জাহাজ কি জেলেডিঙি ডুবলে , জাল ছিড়লে কি ধরা মাছ হাতছাড়া হলে তা সবই ‘ দরিয়ার দানো’র কীর্তিবলে ধরা হত । কেউ কেউ আবার বলত যে , দাননা ’মাঝে মাঝে জেলেডিঙিতে বড় বড় মাছ ছুড়ে দিয়েছে , এমনকি ডুবন্তলােককেও একবার বাঁচিয়েছে । অন্তত একজন হলপ করে বলল যে , একবার যখন সে ডুবছিল তখন তল থেকে কে যেন তাকেঠেলে তুলে তীর পর্যন্ত সঁতরে নিয়ে আসে , আর উদ্ধার পেয়ে সে যখন বালিতে পা দিয়েছে , তক্ষুণি তা অদৃশ্য হয়ে যায় তরঙ্গভঙ্গে। তবে সবচেয়ে তাজ্জবের কথা যে , দানোকে কেউ স্বচক্ষে দেখেনি । কেমন সে দেখতে তা জানা গেল না ।
অবশ্যি এমন লােকও ছিল বৈকি যারা বলল ‘ দাননা’র মাথায় শিঙ আর ছাগলদাড়ি আছে , সিংহের মতাে তার থাবা , মাছের মতো লেজ , কেউ বলল তা মানুষের মতো পা – সমেত শিঙওয়ালা এক প্রকাণ্ড কোলাব্যাঙের মতো দেখতে । বুয়েনাস – আইরেসের সরকারি কর্মকর্তারা প্রথমে এসব গুজবে কোনো কান দেয়নি । আলোড়ন কিন্তু ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল , বিশেষকরে জেলেদের মধ্যে ।
অনেক জেলেই সমুদ্রে যেতে ভয় পেল , মাছ ধরা কমে গেল , টান পড়ল অধিবাসীদের খাবারে । তখন কর্মকর্তারা ব্যাপারটা তদন্তকরে দেখবে ঠিক করল । কয়েকটা স্টিমার আর পুলিশি মোটরলঞ্চ পাঠানো হল উপকূল বরাবর , হুকুম হল , যে অজ্ঞাতপরিচয়ব্যক্তি উপকূলবাসীদের মধ্যে গোলমাল ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে । দু’সপ্তাহ সারা লা – প্লাতা উপসাগর তল্লাশকরে বেড়াল পুলিশ , মিথ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলে কিছু রেড ইন্ডিয়ানকে আটক করল , কিন্তু দরিয়ার দানো’কে ধরা গেল না ।পুলিশকর্তা সরকারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাল যে , ‘ দরিয়ার দানো ’ বলে কেউ নেই , সবই কিছু অজ্ঞলোকের রটনা , তারা ধরাপড়েছে , যথাযোগ্য শাস্তি তারা পাবে , জেলেরা যেন গুজবে বিশ্বাস না করে মাছ ধরায় মন দেয় । কিছুকাল কাজ হল তাতে ।
কিন্তু দানো’র ফষ্টিনষ্টি থামল না । একদিন রাত্রে তীর থেকে অনেক দূরের এক ডিঙিতে জেলেরা জেগে উঠল ছাগলছানার ডাকে , কী করে ওটা ওখানে পৌছল বােঝা গেল না । আরেক দল জেলে জাল টেনে তুলে দেখল তা একেবারে কাটা । ‘ দানো’রনবোদয়ে উল্লসিত হয়ে সাংবাদিকরা এবার বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা চাইল । বিজ্ঞানীরা বললেন , শুধু মানুষের পক্ষে যা সম্ভব তেমনকাজ করতে পারে বলে কোনো সামুদ্রিক জীবের কথা বিজ্ঞান জানে না । স্বল্প বিদিত অতি গভীর কোনো সমুদ্রে তা দেখা দিলেওনয় কথা ছিল’– লিখলেন তাঁরা , তাহলেও সেরূপ জীবের পক্ষে বুদ্ধিমত্ত কাজ করা সম্ভব বলে তারা মানতে পারলেন না ।পুলিশকর্তার সঙ্গে বিজ্ঞানীরাও স্থির করলেন ওটা কোনো বখাটের কারসাজি । তবে সব বিজ্ঞানীই তা ভাবেননি । তাঁরা ঘোড়শশতকের বিখ্যাত জার্মান প্রকৃতিবিদ কনরাড হেসনারের নজির দিলেন — ইনি সাগরকুমারী , সামুদ্রিক দানব , সামদ্রিক সাধু ওসামুদ্রিক বিশপের বিবরণ দিয়ে গেছেন ।