একুশের বইমেলা বাংলা রচনা
ভূমিকা:
‘ মেলা ’ শব্দের অর্থ মিলন । মেলা এদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম অঙ্গ । আর মেলার জগতে মিলন পিয়াসী মানুষেরএক ঐতিহ্যপূর্ণ কৃষ্টি ‘ বইমেলা ‘ । এ মেলায় গ্রন্থ বা বই ক্রয় – বিক্রয়ের মাধ্যমে কিছু সংস্কৃতি সচেতন মানুষের মিলন ঘটে এবংতাদের মধ্যে বিভিন্ন ভাবধারার আদান – প্রদান হয় । এটি লেখক – প্রকাশক – পাঠকদের ভাব বিনিময়ের কেন্দ্রও বটে । এখানেঘটে সভ্যতার প্রাণের চিহ্ন বিচিত্র বিষয়ক অজস্র বইয়ের সমাহার।
বইমেলার ইতিহাস:
ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে স্টুর ব্রিজের মেলা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়।এই মেলায় বইয়ের অংশের নাম ছিল ‘ বুক সেলার্সরা‘ ।বিচ্ছিন্ন কিছু দৃষ্টান্ত বাদ দিলে বইমেলার পর্যায়ক্রমিক উপস্থিতি দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকে।তথন বই বিক্রি ছিলবৃহৎ মেলার অংশ।শিল্পজাত বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য বইকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হতো।আমেরিকার কোম্পানি অব বুক সেলার্সের পরিচালনায় এবং ম্যাথু কেরীর উদ্যোগে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্ক শহরে সর্বপ্রথমবইমেলার পূর্ণাঙ্গ আসর বসে । এরপর ১৮৭৫ সালে একশ জন প্রকাশক মিলে নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে আয়োজন করলেনবইমেলার । ত্রিশ হাজার গ্রন্থ ঐ মেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল । বইয়ের একক ও একমাত্র উপস্থিতি নিয়ে ১৯২৪ সালে আয়োজিত হয়লাইপজিগের বইমেলা । ১৯৪৯ সালে শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টের বৃহৎ বইমেলা । সেখান থেকেই আধুনিক বইমেলার স্মরণীয়শোভাযাত্রা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বের দেশে দেশে বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । সংস্কৃতির নানা উপকরণের মধ্যে এখনবইমেলা হয়ে উঠেছে অন্যতম আধুনিক উপকরণ । বইমেলা হলো আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির বিকাশের অন্যতম ক্ষেত্র ।
বাংলাদেশে বইমেলা :
বাংলাদেশে বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয় । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অমর শহিদদের স্মৃতিকে বাঙালি জাতিরমানসে চির অম্লান করে রাখার প্রয়াসেই প্রথম বইমেলার আয়োজন করা হয় । বর্তমানে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বাংলাএকাডেমি প্রাঙ্গণকে কেন্দ্র করে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপি বিশালাকারে একুশের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।একুশের বইমেলাবর্তমানে জাতীয় জীবনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অন্যতম অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে । ১৯৯৫ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগেনিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে ‘ ঢাকা বইমেলা ‘ । পহেলা জানুয়ারি থেকে আরম্ভ হওয়া পনের দিন স্থায়ী এ বইমেলায় দেশি বিদেশিকবি , সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বই স্থান পায় । এছাড়াও ঢাকায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় গ্রন্থমেলা , যা এদেশেরবইমেলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে । বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বার্ষিক বইমেলার আয়োজনকরে । এদেশের বইমেলার আয়োজনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করে থাকে।জাতীয় পর্যায়ে এসব বইমেলার পাশাপাশি জেলা ও থানা পর্যায়েও অনেক বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে , যাআমাদের গ্রন্থ প্রীতিরই বহিঃপ্রকাশ ।
দেশের বইমেলার চিত্র :
দেশের প্রধান প্রধান বইমেলাগুলোতে দেখা যাবে যে , ছোট ছোট বইয়ের স্টলগুলো মনোরম সাজে সজ্জিত হয়ে প্রদর্শনী ওবিক্রয়ের ব্যবস্থা করছে । পরিচ্ছন্ন – সুন্দর , বর্ণোজ্জ্বল থরে থরে সাজানো থাকে নতুন পাতার গন্ধে মোড়ানো নতুন নতুন বই যাগ্রন্থ প্রেমিকদের বিমোহিত করে।বইমেলায় একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন দেয়া হয়।তবে মেলায় আসা সবাই যে বই কিনে তা নয়অনেকে হাতে তুলে দেখে দু‘একটা পাতা উল্টায় আবার রেখে দেয় । মেলায় ঘুরে বেড়ানোর আকর্ষণকেও একেবারে অস্বীকার করাযায় না । কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে বইমেলাতে আসে । কেউবা বই কেনে , কেউবা মনের আনন্দে বন্ধুদেরনিয়ে বইমেলায় ঘুরে বেড়ায় । বইয়ের দোকান ছাড়াও মেলার মূল অংশের ভেতরে ও বাইরে বাংলার লোকসংস্কৃতি নির্ভর বহুবিচিত্র রকমের পণ্য সম্ভারের পসরা নিয়ে দোকানিরা বসে।মেলায় আসা মানুষদের ফুচকা ও চটপটি খাওয়ার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব ।এছাড়া বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত একুশের বইমেলার অংশ হিসেবে আলোচনা সভা , সংগীতানুষ্ঠান , নতুন লেখকদেরনতুন বইয়ের ওপর আলোচনা , কবিতা ও ছড়া আবৃত্তিসহ নানা রকম বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । সব মিলিয়ে ছোটছোট সোনামণি থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত এখান থেকে লাভ করে এক অনাবিল আনন্দ ।
বইমেলার তাৎপর্য :
গ্রন্থ মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাণসত্তা।গ্রন্থ মানুষে মানুষে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করে।গ্রন্থই মানুষের অতীত বর্তমান – ভবিষ্যতেরসেতুবন্ধন , শুভবুদ্ধি জাগানোর চাবিকাঠি । গ্রন্থপাঠ মানুষের এক দুর্নিবার নেশা।এই নেশাতেই মানুষ ছুটে যায় বইমেলায়।বইমেলা দেশ ও জাতির অগ্রগতির হাতিয়ার । কূপমণ্ডুক অন্ধ ধারণা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেই এর আবির্ভাব।বইমেলা একমহৎ অনুভবেরই প্রেরণাস্থল । এখানে এসে মানুষ এক অনাবিল আনন্দস্রোতে অবগাহন করে । আহরণ করে নতুন প্রাণশক্তি ।বইমেলায় শুধু বই কেনার আগ্রহই নয় , আছে মেলারও এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ।
একুশের বইমেলা :
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক বাংলা একাডেমিরউদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ মেলার সাথে একুশের জাতীয় চেতনা যুক্ত থাকে । বাংলা একাডেমির বইমেলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যেপরিণত হয়েছে । এছাড়াও একটি পাঠানুরাগী প্রজন্ম গড়ে তুলতে এবং আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির লালন ও একুশের বইমেলাপালন করে আসছে অগ্রণী ভূমিকা।ফলে এ দিবসটিকে স্মরণ করে প্রকাশকরা নতুন নতুন বই প্রকাশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।নতুনও পুরাতন লেখকগণ নব উদ্দীপনায় ও নব চেতনায় নতুন নতুন বই রচনায় হাত দেন।কেউ উপন্যাস , গল্প , কবিতার বই লেখেন, আবার কেউ রচনা – প্রকাশনা দুটো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
উপসংহার :
বই জ্ঞানের ভাণ্ডার আর বইমেলা সে জ্ঞানের ভাণ্ডারকে চারদিকে বিতরণ করার সুযোগ করে দেয় । বইমেলা মানুষের চিন্তারঅগ্রগতির এক ধরনের পরিমাপক । তার মাধ্যমে রুচি ও আদর্শের উন্নতি বিধানের সুযোগ মেলে । জাতীয় জীবনে বইমেলারগুরুত্ব অপরিসীম । বই মনকে জাগিয়ে তোলে , মানুষকে জ্ঞান দেয় , জাতিকে বড় করে তোলে । তাই শিক্ষা – সংস্কৃতির প্রসারেরজন্য , মানবিক চেতনা বিস্তারের জন্য বইমেলার অবদানকে স্বাগত জানাতে হবে।