কৃষিকাজে বিজ্ঞান / কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ
ভূমিকা :
আজকের যুগ বিজ্ঞানের যুগ । বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার ও বিকাশ মানবজীবনের সর্বত্র তার কল্যাণ স্পর্শ রেখেছে । প্রতিমুহূর্তে বিজ্ঞান আমাদের জন্য বয়ে আনছে নব নব বিস্ময় । বাংলাদেশ বিমানে একটি বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়ে থাকে যে, ‘ ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী । ‘ কথাটি সত্য , কিন্তু এর মর্মার্থ সম্পূর্ণ সত্য নয় । পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে ঠিকই , কিন্তু তাবিজ্ঞানের বদৌলতে নয় ; বরং বিজ্ঞানের আশীর্বাদে । আর আজ বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ পল্লীগ্রামের কৃষিক্ষেত্র পর্যন্ত প্রসারিত। যেখানে সমস্যার আবর্ত বিজ্ঞানের অগ্রগতি । সমস্যা থেকে রেহাই পাবার জন্য বিজ্ঞান অনবরত গবেষণা করে চলেছে এবংতারই ফলশ্রুতিতে মানবজীবনে আজ এসেছে সুখের স্পর্শ । পাশ্চাত্য দেশের অনুকরণে কৃষিকাজে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েআমাদের দেশেও অভাবনীয় উন্নতি সাধন করা সম্ভব ।
কৃষির আধুনিকায়নে বিজ্ঞান :
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিল্প – বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে ।এর ফলে কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ও কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয় । কাঠের লাঙলের পরিবর্তে মানুষেরহাতে আসে কলের লাঙল– ট্রাক্টর , পাওয়ার টিলার ইত্যাদি । সেচ – ব্যবস্থা এখন ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ শক্তিচালিত পাম্প ।বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে নতুন অকল্পনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছেন । উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে সাফল্যঅভাবনীয় । এসব বীজ সাধারণ বীজের তুলনায় ফসল উৎপাদনে তুলনামূলকভাবে সময়ও কম লাগে । তাতে ফলনও বেশি হয়। আর শক্তিশালী রাসায়নিক সার আবিষ্কৃত হওয়ায় ফসল উৎপাদনে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য । বিভিন্ন প্রক্রিয়ার শীত ঋতুরফসল , শাকসবজি যেকোনো ঋতুতেই উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে । বর্তমানে অনেক গ্রীষ্ম প্রধান দেশে কৃত্রিম ঘরে তাপমাত্রানিয়ন্ত্রণ করে শীতকালীন শাকসবজি চাষ হচ্ছে ।
উন্নত দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান :
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যাটি সারা বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান থাকায় কৃষির উৎপাদন বাড়িয়ে তা মোকাবিলা করার উদ্যোগ উন্নতবিশ্বে দেখা দেয় । ফলে উন্নত বিশ্বে কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ হওয়ায় কৃষির যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে । চাষাবাদপদ্ধতি এখন যান্ত্রিকীকরণ করা হয়েছে । জমি কর্ষণ , বীজ বপন , সেচকাৰ্য , ফসল কাটা , ফসল মাড়াই ও বাছাই ইত্যাদি সবকাজ এখন যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয় । বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে বিজ্ঞানের সহায়তা নেয়াহচ্ছে । কৃষি উপযোগী নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কৃত ও সংস্করণ হচ্ছে । বিভিন্ন কৃষিজ ফসল নিয়ে গবেষণা করে উন্নতমানের ও বেশিপরিমাণে ফলনের বীজ আবিষ্কার করা হয়েছে । বৃষ্টির জন্য এখন আর মানুষ চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়েথাকতে হয় না, বরং তারা আধুনিক সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে অনাবৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টিতে প্রত্যাশিত ফসল ফলাচ্ছে । কৃত্রিমউপায়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা কৃষিক্ষেত্রে নতুন অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে । শক্তিশালী রাসায়নিক সীর আবিষ্কৃতহওয়ায় ফসল উৎপাদনে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য । আমাদের দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদেরদেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ এখনো সম্ভবপর হয় নি । তবে আসল কথা হলো উন্নত ও সমৃদ্ধ বিশ্বের সাহায্যসহযোগিতায় এদেশের জীবনযাত্রা নির্বাহ হচ্ছে বলে কৃষিকাজে বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু অবদান লক্ষ্য করা যাচ্ছে ।সীমিত আকারে হলেও কোনো কোনো দিক দিয়ে বিজ্ঞানের কল্যাণে আমাদের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়েছে । বর্তমানে দেশেকৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , ধান গবেষণা কেন্দ্র , কৃষি বিষয়ক কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কৃষির বিভিন্ন দিক সম্পর্কেউচ্চ মানের গবেষণা চলছে । তবে প্রয়ােজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয় । আমাদের দেশে এখনো জমি খণ্ড – বিখণ্ড ও আইলেরকারণে ব্যাপকভাবে জমিতে ট্রাক্টর ব্যবহার করা যাচ্ছে না । তবে সার ও কঁটিনাশক প্রয়োগে , বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রভৃতিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের সাহায্য নেয়া হচ্ছে । প্রকৃতির ওপরনির্ভরশীল না হয়ে পাম্প এবং গভীর ও অগভীরনলকূপের সাহায্যে পানি সেচ দেয়া হচ্ছে , শস্য মাড়াই ও ভাঙানোর কাজ হচ্ছে কলের সাহায্যে । উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ওশক্তিশালী রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে ।আগে যে জমিতে এক ফসল ফলানো হতো বিজ্ঞানের সাহায্যে এখন সেখানে তিন ফসল ফলানো হচ্ছে ।
বাংলাদেশের কৃষিকাজে বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগের উপায় :
কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে কৃষির উন্নতির ওপরই আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল । কিন্তু কৃষকদের অজ্ঞতার কারণেবৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল আমরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না । তাই কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতেহলে বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটাতে হবে । কৃষকদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করাসহ উক্ত কলাকৌশল প্রয়োগেরজন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান , শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে । এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগ , কর্মসূচি গ্রহণ ওবাস্তবায়ন করতে হবে । দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করে এবং উদার শর্তে ঋণদানের ব্যবস্থা করে কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে হবে । বিভিন্ন সরকারি কৃষি সংস্থার বিজ্ঞানীদের কৃষির ওপর বিভিন্ন গবেষণা বা পরীক্ষা – নিরীক্ষারফল কৃষকদের জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে । কৃষিশিক্ষায় উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মীদের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের আধুনিক কৃষিপদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে । এছাড়া আধুনিক কৃষি শিক্ষারও প্রসার ঘটাতে হবে । কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্নকর্মকাণ্ড গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে হবে । উন্নত বীজ , প্রয়োজনীয় সার , কার্যকর সেচ , ফসল মাড়াই – বাছাই ও ফসলসংরক্ষণ ব্যবস্থা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই আধুনিক বিজ্ঞানের বাস্তব জ্ঞানে কৃষকদের সমৃদ্ধ করতে হবে । আর হাতে কলমে প্রয়োজনীয়প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিটি কৃষককে সচেতন ও দক্ষভাবে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের কৃষিকাজে বিজ্ঞানের সর্বাঙ্গীন প্রয়োগত্বরান্বিত হবে এবং এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অধিকতর নিশ্চিত হবে।
উপসংহার :
কৃষি ও কৃষক জাতির মেরুদণ্ড । কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েআমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক অনগ্রসরতাকে কাটানো সম্ভব । আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক কৃষিজীবী মানুষকে কৃষিক্ষেত্রেআধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারযোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে পারলে আমাদের কৃষকদের দারিদ্রতা দূর হয়ে জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটবে ।মোটকথা , এদেশে উন্নত দেশের কৃষি সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও কলাকৌশলের প্রয়োগ কৃষকদের জীবনে যাতে ইতিবাচক প্রভাববিস্তার করতে পারে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হতে হবে।