ট্রেনে ভ্রমণ বাংলা রচনা
ভূমিকা :
ভ্রমণ সব সময়েই আনন্দের । এই আনন্দের সাথে ভ্রমণে যুক্ত হয় জ্ঞানলাভ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন–বিপুলা এ পৃথিবীরকতটুকু জানি। দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী মানুষের কত কীর্তি , কত নদী গিরি সিন্ধু মরু , কত না অজানা জীব , কত নাঅপরিচিত তরু রয়ে গেল অগোচরে।প্রকৃতপক্ষে , ভ্রমণের ফলে মানুষের চিত্ত যেমন প্রফুল্ল হয় , ঠিক তেমনি সে অনেক অজানারসন্ধান লাভ করে । আমি একদিন ট্রেন ভ্রমণে বের হই।
ভ্রমণ কী ? :
ভ্রমণ হলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বেড়ানো বা পর্যটন । মহানবীর বাণীতে আছে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে সুদূর চীন দেশে যাবারআহ্বান। শ্রীকৃষ্ণও বিশেষ উদ্দেশ্যে মথুরা থেকে বৃন্দাবনে ভ্রমণ করেছেন।ধর্মীয় মহাপুরুষদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা । চন্দ্রপৃষ্ঠ বামহাশূন্যে পরিভ্রমণ করেন । এসব কিছুর সঙ্গেই আছে আনন্দ আর জ্ঞানের পিপাসা । ভ্রমণ মানবমনে আনন্দ দান করে এবংজ্ঞানের পিপাসা মেটায় । সে কারণে অনেকে এটি কর্তব্য কর্ম বলেও মনে করে।
ভ্রমণের পথসমূহ :
সাধারণত স্থলপথ , জলপথ , আকাশপথ এই তিন পথেই ভ্রমণ করা যায় । স্থলপথে বাসভ্ৰমণ , সাইকেল ভ্রমণ , মোটরসাইকেলভ্রমণ , টেক্সি ভ্রমণ ইত্যাদি হতে পারে । তবে পরিসর বড় , দীর্ঘ পথ ক্লান্তিহীনভাবে ভ্রমণের পক্ষে আরামদায়ক রেলভ্রমণ । এতেপথে অনেক স্টেশন থাকায় নানা স্থানের বিচিত্র মানুষের সঙ্গে ক্ষণিক দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটে ।
ট্রেনে ভ্রমণের শুরু :
পরীক্ষা শেষে আমাদের স্কুল বন্ধ । ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে মা – বাবার সঙ্গে সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকার কমলাপুর স্টেশনেগিয়ে পৌছি । সঙ্গে আমার বোন অর্পিতা । উদ্দেশ্য গ্রামের বাড়ি জামালপুরে যাওয়া । আমার বাবা আগেই ট্রেনের টিকিট কাটিয়েরেখেছিলেন । আমরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের সুলভ শ্রেণিতে নির্ধারিত আসনে বসলাম । ট্রেনের নাম ‘ অগ্নিবীণা ‘ । নামটিকাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বই থেকে নেওয়া । সকাল ঠিক নয়টায় ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছাড়ল । ট্রেনের ভেতরের অবস্থাবাবা আমাকে বলেছিলেন , ‘ সুলভ ‘ শ্রেণিতে উঠলে বিচিত্র ধরনের মানুষের দেখা মেলে । সত্যি তাই দেখলাম । নিম্নবিত্ত , মধ্যবিত্ত নানা ধরনের নারী – পুরুষ সেই সঙ্গে শিশুরা আসনে বসেছে । দুজনের আসনে তিন বা চারজনও কষ্ট করে বসে ছিলেন। একজন বৃদ্ধ আসন পাননি । পাশের আসন থেকে একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দিলেন । এরই মধ্যে চানাচুরওয়ালাচানাচুর – বাদাম ‘ বলে মিহি সুর তুলে , আকর্ষণীয় গন্ধ ছড়িয়ে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল । একজন চোখের সামনে দৈনিকপত্রিকা মেলে ধরে তা পাঠ করায় মনোযোগী ছিলেন । ট্রেন ধীরে ধীরে গতিপ্রাপ্ত হয় ।
বিভিন্ন স্টেশন :
আমি ইতোমধ্যে জানালার ধারে গিয়ে বসেছি । বোন অর্পিতা আমার মুখোমুখি বসে । আমার পাশে বাবা আর অর্পিতার পাশেমা বসা । দেখলাম ট্রেন তেজগাঁও , ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট , জয়দেবপুর ইত্যাদি স্টেশনে ক্ষাণিক দাঁড়াল । আর স্টেশনে অপেক্ষামানমানুষগুলো জলদি উঠে পড়ল ট্রেনে । কারও হাতে ছিল ব্যাগ , কারো কোলে শিশু । কিন্তু সবারই একটাই লক্ষ্য এবং তা হলোট্রেন।ট্রেনে উঠেই তাদের সব ব্যস্ততা কমে যায় । যে যার আসন খুঁজে নিয়ে সেখানে বসে যান ।
ট্রেন থেকে :
জানালার ধারে বসে আছি । মনে হচ্ছে মাঠ – ঘাট – গাছপালা দৌড়াচ্ছে । আমার চক্ষু স্থির । কয়েকটা পাখি আকাশে পাখামেলে আমাদের পাশাপাশি চলে আবার পিছিয়ে পড়ে । মনে হয় , সারা পৃথিবী যেন ঘুরছে , আর আমরা স্থির আছি । জানালারধারে বাতাসের গতিবেগের কারণে আমার চুল এলোমেলো হয়ে যায় । পাশে তাকিয়ে দেখি বাবা বই হাতে , মা চোখ বুজে আছেন ।ট্রেন থেকে শূন্য মাঠ দেখা যায় । কিছুদিন আগেও এখানে সোনালি ধান ছিল । একটি বাড়ি দ্রুত চলে যায় । সেখানে গরু আরমো ষ বাঁধা ছিল । দূরে একটি ইটের বাড়িও চোখে পড়ে । অনেক টিনের ঘরের চালে সূর্য চিক চিক করে । পুকুরে গ্রামের বৌঝিরাকাজে ব্যস্ত সেটাও চোখে পড়ে । গ্রাম বাংলার রূপ যে এত সুন্দর তা এর আগে আমার চোখে এভাবে আর ধরা পড়ে নি । কবিলিখেছেন “ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি , তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর জীবনানন্দের এই ভাষ্য যে কতটা সত্য , যেদিন ট্রেনে ভ্রমণ করলাম , সেদিন বুঝতে পারলাম।
উল্লেখযোগ্য স্থান:
ট্রেনে ভ্রমণে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য স্থান ও স্থাপনার মধ্যে পড়ল কমলাপুর রেলস্টেশন । দীর্ঘতম প্লাটফর্ম আছে এই স্টেশনে ।তারপর তেজগাঁও আসার আগেই দূর থেকে চোখে পড়ে ঢাকার চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসি । ভাওয়ালের জমির ওপরদিয়ে জয়দেবপুরে যাবার আগেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চোখে পড়ে । ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। জামালপুরে যমুনা সার কারখানা ছাড়াও পথে নানা স্থান ও স্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায় । সাইন বোর্ডগুলোর ওপর একটুস্থির দৃষ্টি রাখলে স্থান ও স্থাপনাগুলোর নাম ভালোভাবেই পাঠ করা সম্ভব । ট্রেনে ভ্রমণের সময় নানা স্থান ও বিচিত্র স্থাপনাগুলোআমাকে আকৃষ্ট করে।
শেষ স্টেশন :
ট্রেন থেকে নামার আগেই প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সবাই যে যার ব্যাগ হাতে নিলাম । বাবা বড় ব্যাগগুলো এক সঙ্গে রেখে ট্রেনথামার অপেক্ষা করলেন । আমি আমার একপাটি জুতো খুঁজে পাচ্ছিলাম না । অর্পিতা বলল , দিদি তোমার জুতো আমারসিটের নিচে এসে গেছে । ট্রেন থামতেই লাল শার্ট পরা কুলিরা এলো। বাবা তাদের হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিলেন।আমরা নামারচেষ্টায় ব্যস্ত , অনেকে ট্রেনে ওঠার চেষ্টায় মত্ত।এ সময় শৃঙ্খলা দরকার।কিন্তু শৃঙ্খলার বড় অভাব । শেষ পর্যন্ত আমরা জামালপুরস্টেশনে নামলাম।আমাদের সাত ঘণ্টার ট্রেনে ভ্রমণ সমাপ্ত হলো।
উপসংহার :
ট্রেনে ভ্রমণ না করলে জীবনের বিরাট অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম । বিচিত্র মানুষের সঙ্গে পরিচয় , নানা স্থান । অবলোকন , বিভিন্ন স্থাপনা দর্শন ইত্যাদি আমার মনে নানা জিজ্ঞাসার জন্ম দেয় । সুন্দর শ্যামল বাংলাদেশ আমার মনে দেশপ্রেম জাগায়আরও তীব্রভাবে । ট্রেনে ভ্রমণের এই সাতটি ঘন্টা আমার কাছে যেন সাত জনমের অভিজ্ঞতার খণ্ডরূপ ।