বাংলা রচনা সমগ্র

তোমার শৈশব স্মৃতি বাংলা রচনা

ভূমিকা :

ছেলেবেলা বা শৈশব স্মৃতি অর্থ শৈশবের সুখ দুঃখময় কিছু স্মৃতি।শৈশব মানুষের জীবনের মধুরতম সময় সংসার জীবনেরকোনো জটিলতা , উদ্বেগ বা চিন্তা তখন মাথায় আসে না জীবনের যাত্রাপথে মানুষ এগিয়ে চলে ক্রমে ক্রমে , আর সেই সাথেনানা জটিলতার আবর্তে জড়িয়ে পড়ে মানুষ এতটুকু সুখ শান্তি লাভের আশায় শৈশবের দিকে ফিরে তাকায় প্রকৃতপক্ষেমানুষ যখন জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে , তখনই সে তার শৈশবের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে সুখ অনুভব করতে চায়

আমার শৈশবকাল :

আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে , ঝংপুর জেলার ছোট্ট শান্ত একটি গ্রাম পলাশপুর গ্রামে যখন শৈশব কেটেছে তখন তাকে নিয়েইগভীরভাবে ভাবতে শিখিনি কিন্তু আজ মনে পড়েপলাশপুরে কত না সুন্দর ভোর হতো, সকালসন্ধা কত না সুন্দর পাখিরাগাইতো ডানপিটে ছেলে হিসেবে যে কয়জন ছেলে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াত , ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতায় মেতেউঠত , কিংবা হিজল গাছের চূড়া থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তআমি ছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম

শৈশবে লেখাপড়ার স্মৃতি :

শৈশবে লেখাপড়া ছিল নামমাত্র।আমি বাবামায়ের একমাত্র ছেলে বলে তারা কখনো আমাকে লেখাপড়ার জন্য মার কিংবাবকুনি দিতেন না আমার বড় বোন আমাকে সকালসন্ধ্যা বাংলা বর্ণমালা কিংবা ছড়া পড়াতে বসতেন ঘরে বর্ণ পরিচয়েরপাঠ শেষ হলে একদিন ইংরেজি বছরের প্রথমে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকমহোদয় বিদ্যালয়ের খাতায় আমার নাম উঠালেন এবং রীতিমতো বিদ্যালয়ে আসার উপদেশ দিয়ে আদর করলেন প্রথম প্রথমস্কুলের গণ্ডিবদ্ধ জীবন আর অপরিচিত পরিবেশ আমার মোটেই ভালো লাগত না তবে পরবর্তীতে শিক্ষকদের স্নেহ এবংসহপাঠী ছেলেমেয়েদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠায় সহজেই মনের জড়তা কেটে যায়

শৈশবে স্কুল পালানোর স্মৃতি :

শৈশবে স্কুল পালানো ছিল একটি মজার ব্যাপার পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের পাল্লায় পড়ে প্রায়ই স্কুল পালানোর সিদ্ধান্ত নিতাম বাবামাকে স্কুলে না যাওয়ার কথা জানালে তারা কখনোই তা সমর্থন করতেন না তাই রওনা দিতাম ঠিকই , কিন্তু পথে কোথাও বইলুকিয়ে রেখে বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতাম মাঠের ওপারে রেল লাইনে এভাবে সকাল গড়িয়ে বিকাল স্মরণ করেই কবিজসীমউদ্দীন লিখেছেন হলে ধুলি বা কাদা মাখা শরীরে বাড়িতে ফিরতাম আর কখনই শুনতে তো মায়ের রাঙা চোখেআদরমাখা বকুনি এরূপ শৈশবকেওরে মুখপোড়া ওরে রে বাঁদর গালিভরা মার অমনি আদর।

শৈশবে খেলাধুলার স্মৃতি :

শৈশবে দুটুমি আর খেলাধুলাতেই কেটে গেছে দিনের বেশির ভাগ সময় পাড়ার সময়বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে জমে উঠতকানামাছি , হাডুডু , গোল্লাছুটসহ আরো নানা ধরনের খেলা বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুলেও খেলাধুলার প্রতিযোগিতা হতো।দৌড় , সাঁতার দীর্ঘ লাফে সব সময়ই আমি প্রথম হতাম মনে পড়ে , প্রতিযোগিতায় প্রাপ্ত পুরস্কারগুলো নিয়ে যখন মায়ের হাতেতুলে দিতাম তখন মা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আমার কপাল ভরে চুমু খেতেন আরো মনে পড়ে , প্রশস্ত উঠানে বসে রাতে দাদিদৈত্যরাক্ষস আর রাজপুত্রের গল্প শোনাতেন এমনি রাতে অনেক সময় মুখে মুখে ছড়া কেটেছি আর সমবয়সীদের নিয়েখেলার আসর জমিয়েছিওপেনটি বায়স্কোপ রায়টেনে টেলেস্কোপ চুলটানা বিবিয়ানা সাহেব বাবুর বৈঠকখানা

কৈশোরের কথা :

আমাদের পাশের গ্রামে ছিল একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আমার কৈশোর কেটেছে সে বিদ্যালয়ের গণ্ডিতেই বিদ্যালয়টি ছিলনামকরা শিক্ষকদের কড়া শাসন পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয়ের সুনাম বয়ে এনেছিল আর সৃষ্টি হয়েছিল ভালো ফলাফলের ঐতিহ্য বিদ্যালয়ে ছিল নিয়মিত ক্লাস আর পড়ার চাপ ; ছিল চমৎকার একটি পাঠাগার আমাদের স্কুলেসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছিল , ছিল একটি নিয়মিত দেয়াল পত্রিকা ছোট ছোট গল্পকবিতা লেখার মধ্য দিয়েই আমার প্রথমলেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয় দেখতে না দেখতেই কেটে গেল বিদ্যালয়ের পাঁচটি বছর এলো মাধ্যমিক পরীক্ষা পরীক্ষার পূর্বেইআমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয় থেকে বিদায় দেয়া হলো। সহপাঠীদের সাথে গড়ে উঠেছিল আমার আত্মার সম্পর্ক শিক্ষকদের আদরমাখা শাসন আর ভালোবাসা পেয়ে ভুলে গিয়েছিলাম একদিন বিদ্যালয় থেকে আমাদেরকে বিদায় নিতে হবে তাই বিদায় নিতে গিয়ে সেদিন আমরা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না !

স্মরণীয় একটি ঘটনা :

আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি নবম শ্রেণিতে পড়তেন আমাদের পাশের গ্রামের পলাশ ভাই ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেনঅত্যন্ত মেধাবী কথাবার্তা আচারআচরণে তিনি ছিলেন বিনয়ী গান গাওয়া আবৃত্তিতে তার জুড়ি ছিল না একদিনস্কুলে ক্লাস করার সময় হঠাৎ তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা ব্যথায় সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল প্রধান শিক্ষক তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারডাকলেন প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার পর ধরা পড়ল তার ব্রেইন টিউমার একটি দুরারোগ্য ব্যাধি যার চিকিৎসা আমাদেরদেশে নেই বললেই চলে এর কিছু চিকিৎসা উন্নত দেশগুলোতে হয়ে থাকে , তবে তাও আবার ব্যয়বহুল আমরা স্কুল থেকে ছাত্র, শিক্ষক অভিভাবক মিলে চাঁদা তুলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম তার চিকিৎসাও হলো কিন্তু তিনি আর সুস্থ হলেনআমার হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে আছে পলাশ ভাই একদিন আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন পলাশ ভাইয়ের কথা মনেহলে এখনো কষ্ট হয়

স্মৃতিকাতর আমি :

আমার বাবার কর্মস্থল ঢা হওয়াতে আমি এখন ঢাকায় লেখাপড়া করছি গ্রামের মুক্ত জীবনেও এখন নাগরিক উপকরণ যান্ত্রিকতা প্রবেশ করেছে তা সত্ত্বেও আমার শৈশবের স্মৃতি আমাকে পোড়ায় সে মুক্ত বিহঙ্গের মতো দিনগুলো যদি ফিরেআসততা ! সে মুক্তাকাশের নিচে এক দুরন্ত কিশোরের প্রাণখোলা হাসি , বন্ধনহীন জীবনের আস্বাদ কি আর ফিরে আসবে এখনো আমি গ্রামের পাশে মাঠের সোঁদা গন্ধ , পাকা ধানের নেশা জাগানো সুবাস পাই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কল কলস্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিতে চায় নগর জীবনের চৌহদ্দিতে বসে আমি শুধুই স্মৃতিকাতরতায় ভুগি , কখনো কখনো কষ্টও পাই

উপসংহার :

জীবনের পাতা থেকে অনেকগুলো বছর গত হয়েছে , ঝরে গেছে অনেক বসন্ত তবুও শৈশবের সেই দিনগুলো অনন্য মহিমায়ভাস্বর প্রতিক্ষণেই মনে হয় , আবার যদি শিশু হতে পারতাম ; আবার যদি ফিরে পেতাম শৈশবের সেই স্বর্ণালি প্রহরগুলো আজ সেই শিশু জীবন থেকে অনেক দুরে সরে এসেছি তবুও শৈশবের স্মৃতিচারণে আজো মন আনন্দে নেচে ওঠে , কখনো বাচোখ অশ্রুতে সিক্ত হয় মনে হয় সত্যিই শৈশব জীবন কত মধুর ছিল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button