দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার রচনা
ভূমিকা :
বর্তমানে দেশের অন্যতম বিষয় নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি । দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অন্ন , বস্ত্র , বাসস্থান , শিক্ষা ও চিকিৎসা । আর এ মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্নের প্রয়োজন সর্বাগ্রে । কিন্তু খাদ্যদ্রব্য , চাল , ডাল , তেল , লবণ , মরিচ , পিয়াজ , রসুন , মাছ , তরকারি , চিনি , দুধ ইত্যাদি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিকঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তুলেছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ :
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনেক কারণ রয়েছে । যেমন
১। চাহিদা ও যোগান :
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা । চাহিদা তীব্র ও সরবরাহ সীমাবদ্ধ হলে পণ্যের জন্য ক্রেতারভিড় বেড়ে যায় । পণ্য সংগ্রহের জন্য শুরু হয় প্রতিযোগিতা । ফলে অনিবার্যভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
২। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি :
আকস্মিক কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধিতে মজুতদার , মুনাফাখখার , ফটকাবাজ , চোরাচালানি ইত্যাদি অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থান্বেষীভূমিকা থাকে । এরা সুযোগ বুঝে হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে গায়েব করে গোপনে মজুত করে এবং বাজারেকৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে । শুরু হয় কালোবাজারি । পণ্যের জন্য হা – হুতাশ শুরু হলে এই সুযোগে তারা দাম বাড়ায় এবং অল্পঅল্প করে গোপন মজুদ বাজারে ছাড়ে । এভাবে তারা বিপুল টাকা চোরাইপথে হাতিয়ে নেয় ।
৩। বৈদেশিক রপ্তানি :
অনেক সময় বিদেশে পণ্য রপ্তানি লাভজনক হলে রপ্তানিকারকরা সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করে । এর ফলে দেশেও রপ্তানিযোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়ে ।
৪। কর বৃদ্ধি :
অনেক সময় সরকারের মাথাভারি , দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন চালাতে গিয়ে সরকারকে জনগণের ওপর অতিরিক্ত করেরবোঝা চাপাতে হয় । সে কর প্রত্যক্ষ হোক , কিংবা ভ্যাটের আকারে হোক তার ফলে পণ্যের দাম বাড়ে । এই জন্য দেখা যায় , বাজেটে কোনো পণ্যের কর বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলে তার মূল্য রাতারাতি বেড়ে যায় ।
৫। চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি :
আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক দুর্নীতির সুযোগে নিয়ে এক শ্রেণির চাঁদাবাজ ঘাটে ঘাটেজবরদস্তিমূলকভাবে বিভিন্ন গণ – পরিবহন থেকে ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ চাঁদা আদায় করে । স্থানীয় মাস্তান , প্রতিপত্তিশালী সন্ত্রাসী ; দুর্নীতবাজ পুলিশ – সবাই চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হওয়ায় তার অশুভ প্রভাব পড়ে পণ্যমূল্যের ওপর ।
৬। সংরক্ষণ , সরবরাহ ও বন্টনে অব্যবস্থা :
আমাদের দেশে রাজনৈতিক , সামাজিক অস্থিরতার কারণে পরিবহন ধর্মঘট , শ্রমিক ধর্মঘট , রাস্তাঘাট অবরোধ ইত্যাদি নিয়মিতব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । তার ওপর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা , বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরপ্রবণতা পরিলক্ষিত হয় ।
৭। বিশ্ব বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি :
পণ্যমূল্য বৃদ্ধি কেবল বাংলাদেশের একক সমস্যা নয় । আশেপাশের দেশ এমনকি আমেরিকা , ব্রিটেন , জার্মানি প্রভৃতি উন্নতদেশও এ সমস্যা মোকাবিলা করছে । এক অর্থে এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা । এর ফলে আমাদের দেশেও আমদানিকৃত পণ্যের দামবৃদ্ধি পায় ।
৮। জনসংখ্যা বৃদ্ধি :
মানুষ বাড়ছে অথচ জমি বাড়ছে না , বাড়ছে না খাদ্যোৎপাদন । ফলে নিত্যদিনের জিনিসের অপ্রতুল সরবরাহের কারণে দামঅস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৯। জমির উর্বরতা হ্রাস :
যুগ যুগ ধরে আমাদের জমিগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে । জমিতে একই ধরনের ফসল উৎপাদন , সার ওকীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে । কৃষকের প্রত্যাশা অনুযায়ী জমিতে ফসল ফলছে না । অথচচাহিদা বাড়ছে দিনের পর দিন । বাজারে চাহিদার তুলনায় অনেক কম খাদ্যশস্য আমদানি হচ্ছে । ফলে পণ্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিপাচ্ছে ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া :
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে । আমাদের দেশে অধিক দামে দ্রব্য ক্রয় করার সামর্থ্য আছেমুষ্টিমেয় লোকের । তাই যেসব কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে তার প্রভাব সবটাই সাধারণ জনগণের ওপর পড়ে ।অধিক ব্যয় করার সামর্থ্য এদেশের অধিকাংশ জনগণেরই নেই । ফলে বাধ্য হয়ে ব্যয় কমাতে হয় । অনেক সময় দেখা যায় , বেঁচেথাকার তাগিদে অপরিহার্য উপকরণ সংগ্রহ করতেই তাদের হিমশিম খেতে হয় । সাধারণ মানুষের জীবনধারণের খরচ বেড়েযাওয়ার ফলে নেমে যাচ্ছে জীবনধারণের মান , কমছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান । এর প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর । শিশুরাউপযুক্ত যত্নের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভোগে । আর্থিক সঙ্কটের ফলে ছাত্র – ছাত্রীদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে । বাড়তিআয়ের জন্য অনেকে অবৈধ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে । ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় নানা অবক্ষয় ।
প্রতিকারের উপায় :
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি । এ পরিস্থিতির প্রতিকারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়েবিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে । দ্রব্যমূল্যের এরূপ উর্ধ্বগতিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে বিশেষজ্ঞ মহল । মনে করছে ।নিম্নে এ – সম্পর্কে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হলো:
ক , সরকারি উদ্যোগ :
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার একটি দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে । এ আইনের আওতায় দ্রব্যের মূল্যনির্ধারণ , চোরাকারবার প্রতিরোধ , ফড়িয়া ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম হ্রাস ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলাকরা যায় । ব্যবসায়ীরা যাতে ইচ্ছামতাে জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে , সেজন্য একটি প্রবল । নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করেতাদের হাতে এ বিষয়ক দায়িত্ব ন্যস্ত করতে হবে । সেই সাথে ব্যবসায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে এ অবস্থারউন্নতি করা যেতে পারে ।
খ . পণ্যমূল্য নির্ধারণ , আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ :
পণ্যমূল্য নির্ধারণে আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবেসরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় , আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ দায়িত্ব নিতে পারে । সেই সাথে পণ্যমূল্য নির্ধারণ ও তদারকি করারজন্য পণ্যমূল্য মনিটরিং সেল নামে একটি সেল গঠন করে তার কার্যকারিতা জোরদার করা যেতে পারে । নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউপণ্যদ্রব্য কেনাবেচা করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । এভাবে আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেদ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি রোধ করা যেতে পারে ।
সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ :
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতিতে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন । দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্যতালিকা টানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে । এ বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য টিসিবিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে । পাশাপাশি এখন থেকেপ্রতি সপ্তাহে স্পর্শকাতর পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে । বর্তমানআইনানুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক । বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারেআইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিবে ।
উপসংহার :
সরকার ও জনগণ সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সজাগ হয়েছে এবং চোরাকারবারি ও কালোবাজারি ইতোধ্যে সরকার ওজনগণের হাতে লাঞ্ছিত ও শাস্তি ভোগ করছে । ব্যবসায়ী , সরকার ও জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিনিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে । আমাদের এই সুজলা – সুফলা , শস্য – শ্যামলা বাংলদেশ কৃষি , শিল্প ও বাণিজ্যে অদূর ভবিষ্যতে উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে— এ বিশ্বাস আমাদের সকলের ।