বাংলাদেশের দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনা (পরীক্ষায়)

ভূমিকা :
একটি প্রবাদ আছে , “ ছাত্রজীবন সুখের জীবন , যদি না থাকিত পরীক্ষা । ” অনেকের মধ্যে পরীক্ষা ভীতি ‘ হিসেবে কাজ করে ।সারা বছর সঠিকভাবে পড়ালেখা না করে , পরীক্ষা এলে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং যেকোনো উপায়ে পরীক্ষায় পাসের চেষ্টাকরে । প্রয়োজনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয় । প্রচলিত ন্যায়নীতির পরিপন্থী কাজকেই আমরা দুর্নীতি বলে থাকি । যেমন– নকল করা , পরীক্ষায় পাসের ব্যাপারে শিক্ষকের সহযোগিতা নেয়া ইত্যাদি । তাই তো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বা অন্যান্য পরীক্ষাগুলোরসময় খবরের কাগজ খুললেই আমাদের চোখে পড়ে বিভিন্ন শিরোনাম । যেমন– নকলের দায়ে পরীক্ষার্থী বহিষ্কার , পরিদর্শকপ্রহৃত , পুলিশের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি । দেশের এহেন পরিস্থিতিতে চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই উদ্বিগ্ন । এ অবস্থা চলতে থাকলে জাতিহিসেবে আমরা যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই ।
পরীক্ষায় অসদুপায়ের কারণ :
দুর্নীতি সমাজের সর্বস্তরের মতো পরীক্ষার ক্ষেত্রেও সমানভাবে বিরাজ করছে । স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকেই আমাদের দেশে এবিস্তার বিশেষভাবে লক্ষণীয় । এই দুর্নীতি বা অসদুপায়ের পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে , যা নিচে আলোচনা করা হলো:
১। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রটি :
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো সেই পুরনো কাঠামোর ওপরই প্রতিষ্ঠিত । এ শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানার্জনের প্রতিগুরুত্বারোপ না করে পাস করা বা সার্টিফিকেট লাভের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় । এর ফলে ছাত্র – ছাত্রীরা সত্যিকারেরজ্ঞানার্জনের চেয়ে পরীক্ষায় পাস করার নানা কৌশল আয়ত্ত করতেই বেশি সচেষ্ট থাকে ।
২। পরীক্ষা পদ্ধতির ক্রটি :
আমাদের দেশে ছাত্রদের পরীক্ষায় অসদুপায়ের আর একটি বড় কারণ হলো পরীক্ষা পদ্ধতিতে ক্রটি । কয়েকটি বাছাইকৃত প্রশ্নেরউত্তর লিখতে পারলেই পরীক্ষায় পাস করা যায় । এ মানসিকতা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবার মনেই বিদ্যমান । ফলে ছাত্র – ছাত্রীরাকেবল কয়েকটি বাছাইকৃত প্রশ্নের উত্তর শিখে অথবা পরীক্ষার হলে নকলের জন্য তুলে নিয়ে যায় । বিশেষত যারা বিভিন্ন কারণেপ্রশ্নোত্তরগুলো ভালোভাবে মুখস্থ করতে পারে না , তারাই এ অসৎ পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করে ।
৩। রাজনৈতিক কারণ :
আমাদের দেশে প্রায় সারা বছরই রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগে থাকে । ফলে অনেক সময় হরতাল , অবরোধ , বিশৃঙ্খলা ইত্যাদির কারণে স্কুল – কলেজের ছাত্র – ছাত্রীরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারে না । অনেক সময় বিভিন্নশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র – ছাত্রীদের মধ্যে সন্ত্রাস ও মারামারির ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় । একারণেও লেখাপড়ায় বাধা সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ ছাত্র – ছাত্রীদের চরম ক্ষতি সাধিত হয় । ফলে পরীক্ষা এসে গেলে অনেকেইতখন পাস করার আশায় নকলের আশ্রয় গ্রহণ করে
৪। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় :
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ছাত্র – ছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহার পরিবর্তে যেকোনো উপায়ে পরীক্ষা পাসের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে ।অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক মনে করেন , কেবল একটা ডিগ্রি ‘ বা সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলেই তাদের সন্তানরা সমাজেপ্রতিষ্ঠিত হতে পারবে । এ কারণে অনেক অভিভাবক এবং শিক্ষকগণও ছাত্র – ছাত্রীদের পরীক্ষার হলে নকল করতে সাহায্য – সহযোগিতা করতেও দ্বিধাবোধ করেন না ।
৫। শিক্ষকদের ক্রটিপূর্ণ শিক্ষাদান ব্যবস্থা :
পরীক্ষার হলে ছাত্রদের অসদুপায় অবলম্বন করার পেছনে শিক্ষকদের ক্রটিপূর্ণ শিক্ষাদান ব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী । অনেকশিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে শ্রেণিতে তিনি ছাত্রদের সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না ।অনেক অযোগ্য শিক্ষক পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিলেও তাদের দ্বারা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই উপকৃত হয় না । ফলেপরীক্ষা হলে ছাত্র – ছাত্রীরা বাধ্য হয়ে অসদুপায় অবলম্বন করে থাকে ।
প্রতিকারের উপায় :
পরীক্ষায় অসদুপায় প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :
১। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে । এ কাজটি দেশের শিক্ষাবিদ , সমাজবিজ্ঞানীও সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মাধ্যমে করতে হবে ।
২। পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সাধনে শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে । পরীক্ষা পদ্ধতি এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতেছাত্র – ছাত্রীরা নকলের সুযোগ না পায় । রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কারণে স্কুল – কলেজে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ যাতে নষ্টনা হয় , সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে । এছাড়া ছাত্র – ছাত্রীদের আর্থ – সামাজিক উন্নয়নেদেশপ্রেমিক ও সমাজসচেতন ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে । শিক্ষকদের নিয়মিত পাঠদানের ক্ষেত্রে যেসব ত্রুটি – বিচ্যুতি রয়েছে তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে । যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের আর্থ – সামাজিক মানোন্নয়নের দিকে সরকারকে বিশেষ দৃষ্টিদান করতে হবে । সর্বোপরি পাঠ্যসূচিতে অহেতুক বোঝা কমিয়ে বাস্তবভিত্তিকও আনন্দায়ক করে তুলতে হবে । এতে ছাত্র – ছাত্রীরা লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠবে ফলে পরীক্ষায় অসদুপায়অবলম্বনের মাত্রা অনেকখানি কমে যাবে।
পরীক্ষায় দুর্নীতি রোধে সাম্প্রতিক সাফল্য :
সরকার পরীক্ষায় দুর্নীতি রোধে ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । শিক্ষামন্ত্রণালয় ও প্রশাসনেরসুদৃঢ় নকল বিরোধী অবস্থানের কারণে নকল প্রবণতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে । সরকার পরীক্ষার্থী বা হল পরিবর্তন ছাড়াওনকলের জন্য বহিষ্কারের সঙ্গে জেল – জরিমানার ব্যবস্থা করেছে । পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য শিক্ষকদেরকেবহিষ্কার ছাড়াও শাস্তিমূলক চাকরিচ্যুতি ও জেল – জরিমানার ব্যবস্থা নিয়েছে । পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিগৃহীতশিক্ষকদের জন্য নিরাপত্তা ও পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে । ফলে অতি সম্প্রতি নকলরোধে ইতিবাচক ফল ‘ লক্ষ্য করাযাচ্ছে ।
উপসংহার :
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে পরীক্ষায় দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব । এজন্য ছাত্রসমাজকে যেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবেতেমনিভাবে সজাগ হতে হবে অভিভাবক , শিক্ষক , সরকার এবং আপামর জনসাধারণকে । কেবলমাত্র পরীক্ষার হল থেকেদুর্নীতিগ্রস্ত ছাত্রকে বহিষ্কার করলেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না বরং ছাত্র – ছাত্রীদেরকে পড়ালেখার ব্যাপারে আরওমনোযোগী করে তুলতে হবে ।