পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন / বাংলাদেশে বনায়ন (রচনা)
ভূমিকা :
গাছপালা প্রকৃতির অপরিহার্য উপাদান। গাছপালা না থাকলে মানুষ পৃথিবীতে থাকত কিনা সন্দেহ । শুধু মানুষই নয় , গোটাপ্রাণিজগতই ধ্বংস হয়ে পড়ত । কাজেই বলা যায় যে , বৃক্ষ প্রাণিজগতের জন্য অতিশয় প্রয়োজনীয় । বৃক্ষকে টিকিয়ে রাখা , নতুননতুন বৃক্ষরোপন করা , পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বনায়নের ব্যবস্থা করা আজ মানুষের অপরিহার্য কর্তব্য ।
বনায়নের উদ্দেশ্য :
মানুষ আজ অরণ্য ধ্বংসের মাধ্যমে পৃথিবীতে ডেকে আনছে মরুভূমি । অরণ্যই মরুভূমিকে প্রতিরোধ করতে পারে , অরণ্যইমরুভূমিকে শ্যামল স্নিগ্ধ স্নেহময়ী জননীর মূর্তি দান করতে পারে । বনায়নের মাধ্যমে সম্ভব হয় পরিবেশ সংরক্ষণ ও মরুভূমিবশীকরণ । বনায়নের উদ্দেশ্যই হলো অরণ্যের তরুশিশুদলকে মানবসমাজের সান্নিধ্যে আহ্বান করাই তার মূল উদ্দেশ্য ।জনভূমি ও বনভূমির মধ্যে একদিন ব্যবধান ছিল না । কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার নগরকেন্দ্রিকতা অরণ্যকে ধ্বংস করে তার ওপর ইট, কাঠ , পাথরের কৃত্রিম শশাভা স্থাপন করে তাকে মানবজাতির কবরভূমি রচনা করেছে । বনায়নের উদ্দেশ্য এই কবরভূমি থেকেমানবজাতিকে রক্ষা করে একটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ উপহার দেয়া ।
বাংলাদেশের বনভূমি :
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বনায়নের জন্যে অত্যন্ত সহায়ক । আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন আছে । যেমন গাজীপুর জেলারভাওয়ালের গজারি বন , টাঙ্গাইলের মধুপুরের বন , খুলনা বিভাগের সুন্দরবন , পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি , কুমিল্লার,শালবনবিহার ইত্যাদি । এককালে এসব বনাঞ্চল বড় বড় গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল । বর্তমানে বনভূমি প্রায় উজাড় হওয়ার পথে । এতেপরিবেশগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভীষণ সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ।
পরিবেশ ও সামাজিক বনায়ন :
পরিবেশ নিঃসন্দেহে মানব ধাত্রীর মতো। প্রকৃতি ও মানব চরিত্রের মধ্যে বিরোধ নয় , উভয়ের মধ্যে রয়েছে গভীর আত্মীয়তারসম্পর্ক । এই সম্পর্ককে আরো গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে বিশুদ্ধ পরিবেশ দরকার । তাই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যেওবাংলাদেশে বনায়নের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । সামাজিকভাবে বনায়ন কর্মসূচি সফল করতে না পারলে মানুষের উপযোগীপরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় । আমরা জানি , প্রাকৃতিক ভারসায্যের জন্যে বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি আবশ্যক ।কিন্তু সরকারি হিসেবে এখানে বর্তমানে ১৭.৫০ শতাংশ বনভূমি আছে । আবার FAO- এর হিসেবে বাংলাদেশের মোট ভূমির মাত্র১০ শতাংশ বনভূমি রয়েছে । কাজেই আমাদের পরিবেশ ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে বনায়ন বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক । তা না হলেআমরা গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার করাল গ্রাস থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারব না । বিজ্ঞানীদের সমীক্ষায় জানা গেছে যে , গ্রীন হাউসের প্রভাবে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক কিলোমিটার বৃদ্ধি পেতে পারে , আর তাতে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায়২২,৮৮৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে । তাছাড়া আমাদের প্রাণিজগতের বেঁচে থাকার জন্যেপ্রয়োজনীয় উপাদান হলো অক্সিজেন । অক্সিজেন আমরা সাধারণত পেয়ে থাকি গাছপালা বা বনভূমি থেকে । আমাদের দেশেরমানুষের জন্যে যে পরিমাণ বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রয়োজন , সে পরিমাণ অক্সিজেন পাওয়ার মতো বনভূমি আমাদের নেই । তাইমানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজন । মেটানোর জন্যে আমাদের বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবইদরকার । সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি সফল করতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করতে হবে । বনায়নের জন্যে যেশুধু বিশাল বনভূমিকেই বেছে নিতে হবে তা নয় , আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক অনাবাদি জায়গা থাকে , পুকুরপাড়ে পড়েথাকে অনেক জায়গা– এসব জায়গায় গাছপালা লাগিয়ে বনায়ন কর্মসূচি পালন করা যায় । তাছাড়া রাস্তার ধারে , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে ও খেলার মাঠের চারদিকে গাছ লাগানো যায় । এ সমস্ত কর্মসূচি শুরু হলে সামাজিকভাবে মানুষউৎসাহিত হবে এবং বনায়নে এগিয়ে আসবে ।
বনায়নের উপকারিতা :
বনায়নের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না । বনভূমি সূর্যের প্রখর কিরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বনভূমির অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । গাছপালা বায়ু থেকে ক্ষতিকর কার্বনডাই – অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নিজের খাদ্য তৈরি করে এবং বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্যাস বাতাসে ছেড়েদেয় । এই অক্সিজেন আমাদের জীবনধারণের জন্যে একান্ত অপরিহার্য । গাছপালা না থাকলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডেরপরিমাণ বৃদ্ধি পেত এবং অক্সিজেনের অভাবে প্রাণী মারা যেত । একমাত্র গাছপালা বা বনায়নই আমাদের জীবনধারণের সুস্থপরিবেশের নিশ্চয়তা দান করে । তাছাড়া গাছপালা শুধু ছায়া ও শোভাই বিস্তার করে না– ফুল , ফল দান করে এবং প্রয়োজনীয়কাঠ সরবরাহ করে আমাদের অনেক উপকার করে থাকে । গাছ আমাদের উপাদেয় খাদ্য ও অর্থকরী ফল সরবরাহ করে থাকে ।তাই বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম ।
বনায়নে সরকারের ভূমিকা :
বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখা এবং এর সম্প্রসারণের জন্য আমাদের দেশে প্রতি বছর সরকারিভাবে যে বৃক্ষরোপণ অভিযানপরিচালনা করা হয় , তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার । সপ্তাহ , পক্ষকাল বা মাসব্যাপী এ অভিযান চলে । এ সময় পরিকল্পিতউপায়ে বৃক্ষরোপণ করা হয় । সাধারণত প্রতি বছর বর্ষাকালে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে এ অভিযান পরিচালিত হয় ।গাছের চারা যাতে সহজে ও স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় , সেজন্য বনবিভাগ আগেই পর্যাপ্ত চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা করে । এ সময়মানুষ নিকটস্থ নার্সারি থেকে বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারে । অভিযান চলাকালে মানবজীবনেবৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও চারা রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয় । ইতোমধ্যে সামাজিক বনায়নকর্মসূচি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ।
উপসংহার :
বনায়ন যেকোনো দেশ ও জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অপরিহার্য মাধ্যম । দেশের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুপাতে সুষ্ঠুভাবেবনায়ন না হলে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় । এ গাছপালা তথা বনায়নের ওপর ভিত্তি করেই মানুষের জীবনযাত্রা শুরুহয়েছিল এবং এর ওপরই গড়ে উঠেছিল মানবসভ্যতা । অতএব বনায়নকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে আমাদেরসবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।