পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা বাংলা রচনা
ভূমিকা :
মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা , অসীম কৌতূহল । তার এই অনন্ত জিজ্ঞাসা ও অন্তহীন জ্ঞান ধরে রাখে বই । আর বই সংগৃহীত থাকেপাঠাগারে । পাঠাগার হলো সাহিত্য , ইতিহাস , ধর্ম , দর্শন , বিজ্ঞান ইত্যাদির এক বিশাল সংগ্রহশালা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরভাষায় , “ এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে , প্রবাহ স্থির হইয়া আছে , মানবাত্মার অমর আলোকে কালো অক্ষরের শৃঙ্খলেকাগজের কারাগারে বাধা পড়িয়া আছে । ” পাঠাগারের বইয়ের ভান্ডারে সঞ্চিত হয়ে আছে মানবসভ্যতার শত শত বছরেরইতিহাসের হৃদয় – স্পন্দন ।
পাঠাগার কী :
পাঠাগার বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন একটি বাড়ি বা ঘর , যেখানে অনেক বই সংগ্রহ ও সন্ত্রক্ষিত থাকে ।পাঠাগারের শাব্দিক প্রতিশব্দ হচ্ছে পুস্তকাগার , গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি । শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায় , পাঠাগারেরমধ্যে তেমনি মানুষের হৃদয়ের উত্থান – পতনের ধ্বনি শোনা যায় । পাঠক এখানে স্পর্শ পায় সভ্যতার এক শাশ্বত ধারার , অনুভবকরে মহাসমুদ্রের শত শত বছরের কল্লোল ধ্বনি , শুনতে পায় জগতের এক মহা ঐকতানের সুর । তাই পাঠাগার বা লাইব্রেরি হচ্ছেমানুষের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন।
পাঠাগারের ইতিহাস :
পাঠাগারের ইতিহাস বেশ পুরনো।মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের অনেককাল আগে থেকেই পাঠাগারের প্রচলন ছিল । তখন মানুষ তারজ্ঞান সঞ্চিত করে রাখত পাথর , পোড়া মাটি , পাহাড়ের গা , প্যাপিরাস , ভূর্জপত্র বা চামড়ায় । আর এগুলো সংরক্ষণ করা ।হতো লেখকের নিজের বাড়িতে , মন্দির উপাসনালয়ে এবং রাজকীয় ভবনে । খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরেপাঠাগারের অস্তিত্ব ছিল । প্রাচীন গ্রিসেও পাঠাগার ছিল বলে প্রমাণ রয়েছে । ভারতে প্রাচীনকালে পণ্ডিতদের ব্যক্তিগত পাঠাগারছিল । পরবর্তীকালে বৌদ্ধ বিহারসহ বিভিন্ন উপাসনালয় , নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিক্রমশীলায় সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে ওঠে ।এছাড়া আসিরিয়া , আলেকজান্দ্রিয়া , বাগদাদ , দামেস্ক , চীন , তিব্বতসহ বহুস্থানে পৃথিবী – বিখ্যাত পাঠাগারের সন্ধান পাওয়াযায়।
পাঠাগারের বিকাশ :
আধুনিক কালে বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নত পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । বিশ্ববিখ্যাত পাঠাগারের মধ্যে লন্ডনের ব্রিটিশমিউজিয়াম , মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি , ফ্রান্সের বিবৃলিওথি নাৎসিওনাল লাইব্রেরি , ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস , কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য । আমাদের দেশে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ‘ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে ।এই লাইব্রেরির , সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি– বেসরকারি পর্যায়ে শতাধিক পাঠাগার পরিচালিত হচ্ছে । এছাড়াঢাকায় বাংলা একাডেমী । গ্রন্থাগার , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার , জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র , এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি , ব্রিটিশকাউন্সিল লাইব্রেরি , রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম , খুলনার উমেশচন্দ্র সৃতি গ্রন্থাগার সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । বর্তমানে বিশ্বেরবিভিন্ন দেশে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার স্থাপন করে মানুষের জ্ঞানপিপাসা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা আরও বেগবান হয়েছে । ঢাকারবিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের প্রচলন করে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।
পাঠাগারের শ্রেণিবিভাগ :
বিশ্বে নানা রকম পাঠাগার রয়েছে । তার মধ্যে ব্যক্তিগত পাঠাগার , পারিবারিক পাঠাগার , সাধারণ পাঠাগার , জাতীয় পাঠাগারউল্লেখযোগ্য । ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পাঠাগারের পরিসর সীমিত। সাধারণ পাঠাগার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত , তাই এরপরিসর অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । স্কুল , কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র – শিক্ষকের প্রয়োজনে যে পাঠাগার গড়ে ওঠে সেগুলোপ্রাতিষ্ঠানিক পাঠাগার।বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবেও পাঠাগার স্থাপন করা হয়ে থাকে। এগুলোই জাতীয় পাঠাগার।
পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা :
মানুষের শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের দরকার , তেমনি মনের খাদ্যও তার প্রয়োজন । এই প্রয়োজন মেটাতে পারে পাঠাগার ।পাঠাগার মানুষের ক্লান্ত , বুভুক্ষু মনকে আনন্দ দেয় । তার জ্ঞান প্রসারে রুচিবোধ জাগ্রত করে । পাঠাগারে সংগৃহীত থাকে নানামত ও পথের বই । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় : “ লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি । কোনপথে অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে , কোন পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে , কোন পথ মানব হৃদয়ের অতল স্পর্শ করিয়াছে । যে যেদিকে ইচ্ছাধাবমান হও কোথাও বাধা পাইবে না । মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে । ” সমৃদ্ধ পাঠাগারসব ধরনের পাঠাগারের মাধ্যমেই একটি জাতি উন্নত , শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে । জাতীয় জীবনে তাইপাঠাগারের পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করে মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে অবদান রাখে । বই ছাড়া প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করাযায় না । তাই । প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তব্যগুরুত্বপূর্ণ।গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে রাখে অমূল্য অবদান । ” বইপড়ার যে আনন্দ মানুষের মনে , তাকে জাগ্রত করে তুলতে আজ সব ধরনের পাঠাগারের ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন ।
উপসংহার :
পাঠাগার মানবসভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিক ইতিহাস , মানব – হৃদয়ের মিলনক্ষেত্র।সুস্থ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে পাঠাগারএকান্ত অপরিহার্য । স্কুল – কলেজের উপরে পাঠাগারের স্থান।জাতির প্রকৃত , জ্ঞানার্জন ও প্রাণশক্তির বৃদ্ধির জন্য স্কুল কলেজেরমতো দেশের সবখানে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা আজ অত্যন্ত জরুরি।