বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও তার প্রতিকার (রচনা)

ভূমিকা :
কোনো দেশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় , গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে জনসংখ্যা । তবে দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিপেলে অল্প সময়ে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে , কিন্তু সে হারে উৎপাদন বাড়ে না । কারণ বর্ধিতজনসংখ্যার বেশির ভাগ থাকে উৎপাদনে অক্ষম । সুতরাং উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া কোনো কারণে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তাজনগণের জীবনমান উন্নয়ন ব্যাহত করে এবং দেশে হাজারো সমস্যা সৃষ্টি করে । বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণসামাজিক সমস্যা হলো জনসংখ্যা সমস্যা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব :
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ । ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এদেশের জীবনযাত্রায় নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আবাসিক সমস্যা যেমন প্রকট হয়েছে , তেমনি খাদ্য সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে । দেশে বর্তমানে যেভাবে জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে সে অনুপাতে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে না । প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত ২৩ মানুষ দেশেরজনসংখ্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে । ফলে খাদ্যাভাব , পুষ্টিহীনতা , মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা , বেকার সমস্যা , দ্রব্যমূল্য শিক্ষার অভাব, চিকিৎসা সুবিধার স্বল্পতা প্রভৃতি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে । ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নমারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ :
সন্তান জন্মদান ও বংশবৃদ্ধি মানুষের সহজাত জৈবিক প্রবণতা । অন্যদিকে , জনসংখ্যার সাধারণ বশিষ্ট্য হলো এটি ক্রমবর্ধমান। সুতরাং জনসংখ্যা সমস্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে হলে সামগ্রিক ও বহুমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ আ যুক্তিযুক্ত । বাংলাদেশেরপ্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
১। জন্ম ও মৃত্যু হারের ব্যবধান:
বাংলাদেশে একদিকে যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে , তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বর্তমানে শিত অতীতের তুলনায়হ্রাস পাচ্ছে এবং গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে । আর শিশু মৃত্যুহার এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক ভূমিকাপালন করছে ।
২।দরিদ্র :
বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম । আর জীবনযাত্রার মান ও সন্তান জন্মদানেরজন্য বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান । উচ্চশ্রেণি তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য কম সন্তান কামনা করে । পক্ষান্তরে , দরিদ্র শ্রেণি তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রত্যাশায় অধিক সন্তান কামনা করে ।
৩। অজ্ঞতা , অসচেতনতা ও নিরক্ষরতা :
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ নিরক্ষর ও অজ্ঞ । ফলে তাদের মাঝে কুপ্রথা ও কুসংস্কার অতিমাত্রায় বিরাজ করে । তাদেরঅজ্ঞানতার কারণে তারা ব্যক্তিগত , পারিবারিক , সামাজিক তথা জাতীয় জীবনে অধিক জনসংখ্যার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কেসম্পূর্ণ অসচেতন । ফলে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে না এবং অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে । পরিণামে দেশেরজনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৪। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ :
বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের প্রচলন রয়েছে । একজন মহিলা সাধারণত ১২–৫০ বছর বয়স পর্যন্তপ্রজননক্ষম থাকে । আর অল্প বয়সে বিয়ে হবার ফলে অধিক সময় প্রজননক্ষম থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয় । এর ফলে অধিকসন্তানের জন্ম দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে ।
৫। আবহাওয়া :
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ মৌসুমী অঞ্চলে অবস্থিত । ফলে এদেশের আবহাওয়ায় অল্প বয়সেইছেলেমেয়েরা যৌবনপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাও অনেক বেশি । এটি বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে ।
৬। কৃষিভিত্তিক সমাজ কাঠামো :
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা প্রধানত কৃষিভিত্তিক । আর অধিক সন্তান কৃষিকাজের জন্য খুবই সহায়ক । এজন্য কৃষিকাজেরসুবিধার্থে অধিক সন্তান জন্মদানের প্রবণতা আমাদের দেশের অনেক পরিবারে লক্ষ্য করা যায় ।
৭। পুত্র সন্তান লাভের তীব্র আকাক্ষা :
পুত্র সন্তান লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অন্যতম প্রধান কারণ । অনেক শিক্ষিত ও আধুনিকপরিবারেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । এদেশের অধিকাংশ জনগণ মনে করে যতদিন পর্যন্ত পুত্র সন্তান না আসবে ততদিন পর্যন্তকন্যা সন্তানের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন তাতে কারো কিছু যায় আসে না । ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা সমাধানের উপায় :
বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি জটিল ব্যাপার । একক ও স্বল্পকালীন কর্মসূচির মাধ্যমে এ সমস্যারসমাধান সম্ভব নয় । এর জন্য ব্যাপক ও বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন । বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানেরসম্ভাব্য উপায়সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:
১। বাস্তব তথ্যনির্ভর জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন :
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যার সমাধানের জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতি এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ । আর এর জন্যদরকার জনসংখ্যা সমস্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা তথ্যের আলোকে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন , শিক্ষা , স্বাস্থ্য , চিত্তবিনোদনপ্রভৃতি দিকের প্রতি সমভাবে গুরুত্ব প্রদানপূর্বক বাস্তবায়নযোগ্য করে জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন ।
২। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সম্প্রসারণ :
জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের জন্য দেশে আরো ব্যাপকভাবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে । আরো অধিকসংখ্যক ক্লিনিক সৃষ্টি , মাঠকর্মী ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং উন্নত যন্ত্রপাতি ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
৩। গণসচেতনতা বৃদ্ধিকরণ :
জনসংখ্যার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে । এজন্য বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষাকর্মসূচি , আলোচনা সভা , বেতার ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম , যাত্রা , নাটক , থিয়েটার , জারিগান , কবিগান প্রভৃতির মাধ্যমে এসমস্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সম্পূর্ণভাবে সচেতন করে তোলার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত ।
৪। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ :
জনসংখ্যা সমস্যা প্রতিরোধ করতে হলে যেকোনো মূল্যে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রতিরোধ করতে হবে । প্রয়োজনবোধে এরবিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
৫। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন :
ধর্মীয় অনুভূতি এবং অনুশাসনের প্রভাবে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে কম উৎসাহী । তাই এঅবস্থার উন্নতির জন্য মাদ্রাসার শিক্ষক , মসজিদের ইমাম , ধর্মীয় সংস্থার প্রধান এবং বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সহজ ও বোধগম্যভাষায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত তথ্যাদি প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে ।
উপসংহার :
জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই ভয়াবহ সমস্যা সমাধানকয়ে সরকার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন । জনগণের মধ্যে থেকে অশিক্ষাদূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে । সর্বোপরি পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে সরকার বহুমুখী কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করে ব্যাপারেজনগণকে সচেতন করে তুলেছেন । জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ সমস্যা শুধু সরকারি উদ্যোগেই সমাধান করা যাবে না । এজন্য সকলপর্যায়ের মানুষকে সচেতন হতে হবে।