বিশ্ব শিশু দিবস রচনা

ভূমিকা:
শিশুরাই অনাগত দিনের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক । তারাই ভবিষ্যতের বার্তা বয়ে আনে । তাদের মধ্যে সুপ্ত থাকে আগামী দিনেরপৃথিবীর স্বপ্ন , কল্পনা ও সম্ভাবনার নতুন ইতিহাস । আজ যারা নবজাতক , যারা হাঁটি – হাঁটি পা – পা করে ধরণী বক্ষে নতুনপদচারণা শুরু করেছে , তাদের কথা আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না । অনাগত দিনে তারাই শৈশবের কিশলয় দশা ঘুচিয়ে পূর্ণপরিণত হবে । যৌবনের শ্যামল গৌরবে । সেদিন তাদের হাতে থাকবে বিশ্ব শাসকদের নিয়ন্ত্ৰণী শক্তি । ভাবতে অবাক লাগে , আজকের নবজাতকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনাগত দিনের কত শিল্পী স্রষ্টা , সাধক – সাধিকা , স্বদেশপ্রাণ মহাপুরুষ । তাইসমাজ ও মানুষের কর্তব্য শিশুদের প্রতিভা শক্তি বিকাশের সুযোগ করে দেয়া , তাদের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের পথ খুলে দেয়া ।
বিশ্ব শিশু দিবস কী:
জাতিসংঘ ১৯৫৪ সালে এ দিবসটি পালনের ঘোষণা করে । প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস ‘ পালনকরা হয়ে থাকে । এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো– শিশু কিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার ও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথবাতলিয়ে দেয়ার অঙ্গিকার পুনর্ব্যক্ত করা ।
শিশু দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় ও বেদনাদায়ক স্মৃতি এ দিবসটির জন্ম দেয় । ওই সময় এশিয়া , আফ্রিকা ও ইউরোপে শত শতফুলের মতো নিস্পাপ শিশু মারা যায় । অনেক বড় শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় । হাজার হাজার শিশু অসহায় ও পিতৃমাতৃহীনহয়ে পড়ে । পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয় অনেকে । জাতিসংঘ শিশু কল্যাণ তহবিল ( UNICEF ) এই অসহায় শিশুদের কল্যাণ ওনিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসে এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । এদিন সামগ্রিক আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুদের সমস্যাবলি বিশ্ব ফোরামে তুলে ধরে এবং সমাধানের পথ খুঁজেবের করে । তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
শিশু দিবসের তাৎপর্য:
বিশ্ব শিশু দিবসের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক । এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের কল্যাণ সাধন এ তাদের নানাবিধসমস্যার সুষ্ঠু সমাধান । অধিকাংশ মানুষ এখনো বিশ্ব শিশু দিবস ‘ সম্পর্কে সচেতন নয় । এজন্য এ দিবসটির কর্মসূচিএমনভাবে করতে হবে যেন জনগণ এর তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে । কেবলমাত্র কাগজে – কলমে শিশুদেরঅধিকার লিখে সুফল পাওয়া সম্ভব নয় । তাই বাস্তবে এর রূপ দিতে হবে । এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়েআসতে হবে ।
শিশু সনদ :
সম্মিলিত জাতিসংঘের ১৯৫৯ সালে প্রথম ” শিশু অধিকার সনদ ” নামে প্রস্তাবনা গৃহীত হয় । এরপর ১৯৭৯ সালে বিশেষ শিশুবছর ’ পালিত হয় । ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানগণ শিশুর অধিকার নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে ৫৪ টিধারা সংবলিত “ শিশু অধিকার সনদ ” ঘোষণা করে । এ সনদ ‘ শিশু অধিকার সনদ –৯০ ‘ নামে পরিচিত ।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ:
পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগই শিশু । এটি পরম সত্য যে , শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ । এরাই আগামীদিনেররাষ্ট্রনায়ক এবং জাতির কর্ণধার । একটি নবজাত শিশুর মধ্যে আজ যে প্রাণের সঞ্চার হলো তা একদিন ফুলে ফুলে প্রস্ফুটিতহবে।বড় হয়ে একদিন সে জাতির আশা – আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সফল করবে , হবে দেশের আদর্শ নাগরিক । এ জন্য চাইশিশুর সযত্ন প্রতিপালন , বিকাশ সাধনের সুষ্ঠু পরিবেশ । শিশুদেরকে আদর , সোহাগ , যত্ন ও সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলারজন্য চাই অনুকূল পরিবেশ , উপযুক্ত শিক্ষা । উপযুক্ত অভিভাবক পেলে একটি শিশু আদর্শ মানুষরূপে বড় হয়ে ওঠতে পারে ।শিশুর মন ফুলের মতো পবিত্র , সরল । সে যে পরিবেশে থাকে সে তার পারিপার্শ্বিক আচার – আচরণ অনুকরণ করে এবং তাতেঅভ্যস্ত হয়ে পড়ে । একটি নির্মল ফুলের মতো পবিত্র শিশু খারাপ পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে , কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ , অসৎসঙ্গ ও বিবেচনাহীন অভিভাবকের অধীনে বড় হয়ে অমানুষ , বিবেকহীন ও লম্পট চরিত্রের হতে পারে । সম্ভাবনাময়আগামী দিনের এক সুনাগরিক এভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট পিতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে । তাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন করাপ্রয়োজন ।
শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য :
শিশু যে জাতিরই হোক না কেন শিশু শিত্তই । এদের প্রতি জাতি – গোত্রে – বর্ণ নির্বিশেষে অত্যন্ত যত্নশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হতেহবে । শিশুর প্রতি অযত্ন , অবহেলা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে করা উচিত নয় । ফুলের অযত্ন ও শিশুর অযত্ন একই কথা। শিশু ফুলের মতো পবিত্র , নিস্পাপ ও আদরের ধন । সুন্দর মানবসমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শিশুকে গড়তে হবে । বিত্তবানদেশগুলোর কেউ বিলাস – ব্যাসনে কাটাচ্ছে আবার কেউ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মাতোয়ারা । এর অর্ধাংশ মনুষ্যসমাজ গড়ার জন্যযদি ব্যয় করতো তাহলে শান্তির প্রত্যাশা আমাদের জন্য কঠিন হতো না । বাজেটের একটি নির্দিষ্ট অংশ শিশুদের উন্নয়নের জন্যব্যয় ধরতে হবে । এদের বিকাশ সাধনের জন্য গড়ে তুলতে হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ।
বিশ্বে শিশুদের অবস্থান :
জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকারগুলো সবদেশেই স্বীকৃতি পেয়েছে । কিন্তু স্বীকৃতিদানকারী বহু দেশে এ অধিকারগুলো নানাকারণে বাস্তবায়িত হয় নি । বিশ্বের একটি অংশের শিশুরা যেসব অধিকার ভোগ করছে অপর অংশের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিতথাকছে । সেসৰ অধিকার ভোগের কোনো সুযোগই তাদের নেই । তারা পাচ্ছে না ক্ষুধার অন্ন , পরনের কাপড় , স্বাস্থ্য আর শিক্ষারসুবিধা । সমগ্র বিশ্বে অধিকার বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বর্তমানে একশ কোটিরও বেশি । এমনকি অনেক মানব সন্তান আছে যারাবেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছে না । বিশেষ করে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে এমনি অবহেলিত ওঅধিকার বঞ্চিত শিশুর সংখ্যাই সর্বাধিক । সারা বিশ্বে অপুষ্টিতে ভুগে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ শিশু অকালে পৃথিবী থেকেবিদায় নিচ্ছে।
বাংলাদেশের শিশুদের বর্তমান অবস্থা :
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ধারাগুলো সবদেশে মেনে নিলেও বিশ্বেরউন্নয়নশীল গরিব দেশগুলো অর্থনৈতিক কারণে ধারাগুলো পুরোপুরি কার্যকর করতে পারছে না । বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচকোটি শিশু কিশোর রয়েছে । এদের জন্য খাদ্য , বস্ত্র , স্বাস্থ্য , বাসস্থান ও শিক্ষার মতোমৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করাসম্ভব হচ্ছে না । শুধু বাংলাদেশেই নয় ; ভারত , নেপাল , মায়ানমার , মালয়েশিয়া , শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি কোনো দেশেই শিশুঅধিকার সনদ পুরোপুরি কার্যকর রা সম্ভব হয়নি । এর মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য , অর্থনৈতিক সঙ্কট ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি । তবে চরমহতাশার মধ্যেও আশার কথা এই যে , ইতোমধ্যেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে কল – কারখানায় ও রাস্তাঘাটে কর্মরত শিশুশ্রমিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে । তাছাড়া শিশু একাডেমী গড়ে তোলা হয়েছে । কচিকাঁচার আসর , ফুলকুঁড়ি , শাপলা – শালুক , খেলাঘর , কচি – কণ্ঠ ইত্যাদি অনেক শিশু সংগঠন তৈরি করা হয়েছে । শিশু , নবারুণ , সবুজ পাতা– এসব শিশুপত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় প্রচার মাধ্যমেও বিভিন্ন আঙ্গিকের অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয় ; যেমন– অঙ্কুর , নতুন কুঁড়ি ইত্যাদি।
উপসংহার:
মনের দিক থেকে আমরা যদি প্রস্তুতি নিতে না পারি তাহলে আইন করে , সনদ দিয়ে শিশুর অধিকার আদায় করা যাবে সুস্থ , সুন্দর শিশু জাতি গঠনের সহায়ক । আমরাও একদিন শিশু ছিলাম । ছোটবেলায় ফুল নিয়ে খেলা করেছি । এ সুন্দর ধরণীতেপরিবেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ আমরা বড় হয়েছি , ফুল ছেড়ে কলম ধরেছি– এ শক্তি চেতনা আমরা আমাদেরবিকাশের য্যেই লাভ করেছি । সে জায়গাগুলো শিশুদের দ্বারাই পূরণ হবে এবং হচ্ছে । তাই আমাদের অঙ্গিকার হওয়া উচিত , সুষমামণ্ডিত | পৃথিবী গড়ে তুলতে সুন্দর সন্তান চাই । বিশ্ব শিশু দিবসে এটিই হোক আমাদের স্লোগান।