বাংলাদেশের কৃষক (রচনা)
ভূমিকা :
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ । এদেশের শতকরা প্রায় ৫ ভাগ লোক কৃষক । বাংলাদেশ শস্যশ্যামল তথা ধনধান্যে পুষ্পে ভরা একসমৃদ্ধ সুন্দর দেশ । কৃষকরা এ দেশের প্রাণ । শ্রম দিয়ে শস্য ফলিয়ে তারা এদেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে । কিন্তু দুঃখের বিষয়বাঙালির স্বাধীনতা লাভের প্রায় অর্ধশত বছর কেটে গেছে কিন্তু কৃষকদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি । আগে তারা অল্পেতুষ্ট ছিল তাই দরিদ্র সংসারেও হাসি ছিল , প্রীতি প্রেম ছিল । তারা ঋণগ্রত ছিল না । এখন তাদের সেদিন আর নেই ।
কৃষকের অতীত :
প্রাচীনকালে এ দেশে জনসংখ্যা ছিল কম , জমি ছিল বেশি । উর্বর জমিতে প্রচুর ফসল হতো । তখন শতকরা ৮৫ জনই ছিলকৃষক । তাদের গোলা ভরা ধান , গোয়াল ভরা গরু আরা পুকুর ভরা মাছ থাকত । তাদের জীবন ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ । তারপরএলো বৰ্গীর অত্যাচার ফিরিঙ্গি – পর্তুগিজ জলদস্যুদের নির্যাতন , ইংরেজদের খাজনা আদায়ের আইন , শোষণ ও নিপীড়ন ।এলো মন্বন্তর , মহামারী । গ্রাম – বাংলা উজাড় হলো। কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেল । সম্পদশালী কৃষক পরিণত হলো ভূমিহীন চাষিতে। দারিদ্র্য তাকে কোণঠাসা করলো । কৃষকের জীবন হয়ে উঠল বেদনাদায়ক । কবিগুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়— কম্বে যততার চাপে ভার বহি চলে মন্দগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার তারপর সন্তানের দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি । শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনমতে কষ্ট – ক্লিষ্টপ্রাণ রেখে দেয় বাঁচাইয়া ।
বর্তমান অবস্থা :
বাংলা রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে । বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে । কিন্তু কালের চক্রে আজ বাংলারকৃষকেরা নিষ্পেষিত । বাঙালি কৃষকের উদ্বাস্তু , অসহায় ও বিষ জীবনের কোনো রূপান্তর ঘটেনি । বাংলার কৃষক আজোশিক্ষাহীন , বস্ত্রহীন , চিকিৎসাহীন , জীবন – যাপন করছে । দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে , কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ । জমিরউর্বরতাও গেছে কমে । ফলে বাড়তি মানুষের খাদ্য যোগানের শক্তি হারিয়েছে এ দেশের কৃষক । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উন্নত দেশেকৃষকের শক্তি বৃদ্ধি করছে । কিন্তু এ দেশে এখনো মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ ব্যবস্থা বহাল আছে । তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থারপরিবর্তন ঘটছে । কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগের গুরুত্ব বাড়ছে । সম্প্রতি ব্যাংক , সমবায় সমিতি বামহাজনের ঋণের টাকায় আর উচ্চ ফলনশীল বীজের সাহায্যে কৃষিতে ফলন বাড়ছে । কিন্তু ক্ষেতের ফসল কৃষকের ঘরে ওঠারআগেই ব্যাংক , সমবায় সমিতি কিংবা মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তাই কৃষকের সুখ – স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় । কৃষিবাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন হলেও কৃষকের শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হয় না । এখন তারা নানা রোগ– শোকে , অশিক্ষা – কুশিক্ষা , দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ।
কৃষকের উন্নয়ন :
কৃষকের উন্নতি মনে জাতির উন্নতি । দেশীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদানও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ । তাই দেশের উন্নয়নের স্বার্থেকৃষকের উন্নয়ন সাধন করা দরকার । দেশকে উন্নত করতে হলে গ্রামকে উন্নত করতে হবে । গ্রামকে উন্নত করতে হলে গ্রামেরমানুষের অর্থাৎ কৃষকের উন্নতি করতে হবে । বৈজ্ঞানিক চাষবাসের ব্যবস্থা করতে হবে । উন্নত বীজ সরবরাহ করতে হবে । সেচ ওসারের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে । কৃষকদেরকে ঋণমুক্ত করে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে । তবেই কৃষকের উন্নতি হবে । কৃষকতার পণ্য দ্রব্যের ন্যায্য মূল্য পাবে । আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই অশিক্ষিত । তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে । আধুনিকযন্ত্রপাতি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে । সারা বছর কৃষকের কাজ থাকে না । তাই তারা অবসর সময়ে অর্থপূর্ণ করার জন্য কুটিরশিল্প সম্পর্কে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে হবে ।
উপসংহার :
বাংলার কৃষকরাই বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড । বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি তারা । তবুও কৃষকরা বহুকাল ধরে অবহেলিত। বিশেষ করে তাদের সামাজিক মর্যাদা এখনো নিম্নমানের । এ বিষয়ে আমাদের সকলের সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে । কৃষক ওকৃষিকে গুরুত্ব দিলেই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে । দেশের দারিদ্র্য দূর হবে । বাংলার ঘরে ঘরে ফুটে উঠবেস্বাচ্ছন্দ্যের ছবি । বলা যায় , কৃষকের আত্মার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বীজ ।