বাংলাদেশের সোনালী আঁশ /বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল /বাংলাদেশের স্বর্ণসূত্র রচনা
ভূমিকা :
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ । দারিদ্র্যপীড়িত আমাদের এদেশে তেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদেরপ্রাচুর্য নেই , নেই কোনো সচ্ছলতার আলাদীন প্রদীপ । তবে আছে সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ উর্বর মাটি । উর্বরতায় অতুলনীয়এ মাটিতে জন্মানো সবুজ শস্যমালার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো পাট । পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল । প্রতি বছর বাংলাদেশবিদেশে পাট রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করে বলে পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ ।
উৎপত্তিস্থান :
পৃথিবীর সিংহ ভাগ পাট বাংলাদেশে জন্মে । বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী । প্রতি বছরএদেশে প্রায় ২০ লক্ষ একর জমিতে পাট চাষ করা হয় । উৎপাদিত পাটের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি মণ । বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, জামালপুর , টাঙ্গাইল , ঢাকা , কুমিল্লা , ফরিদপুর , পাবনা ও রাজশাহী জেলায় প্রচুর পাট জন্মে ।
বর্ণনা :
পাট এক ধরনের সরু লম্বা আকারের গাছের আঁশ । প্রতিটি পাট গাছ প্রায় ৭–৮ হাত লম্বা হয় । গাছটির কোনো ডালপালা থাকেনা । তবে ফুল আসার সময় কিছু ছোট ডাল গাছের মাথার দিকে ছড়ায় । গাছের মাথায় কিছু পাতা থাকে । পাটের পাতারকিনারা খাঁজকাটা ও নরম । নিচের দিকের পাতা গাছ বাড়ার সাথে সাথে ঝরে পড়ে এবং পাতা মাটিতে পচে প্রচুর জৈব পদার্থযোগ করে । পাট গাছের রং সবুজ । পাট গাছের ভেতরে থাকে একটি নরম কাঠি , এ পাটকাঠি জড়িয়ে যে আঁশ থাকে তা পানিতেপচিয়ে বের করলেই পাটে রূপান্তরিত হয় । বাংলাদেশের পাট উন্নতমানের।
চাষ প্রণালি :
পাট চাষের জমি উত্তমরূপে চাষ করতে হয় । উঁচু জমিতে ফারুন – চৈত্র মাসে দেশি পাটের বীজ প্রতি হেক্টরে ৮–১০ কেজি বপনকরা হয় । নিচু জমিতে চৈত্র – বৈশাখ মাসে পাটের বীজ প্রতি হেক্টরে ৬–৮ কেজি ছিটানো হয় । বীজ থেকে চারা প্রজননেরকিছুদিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা উঠানো হয় । প্রয়োজনে পাতলাকরণ ও খালি জায়গায় পূরণ করতে হয় । বর্ষাকালে পানিপেলে পাট গাছ বেড়ে ওঠে । আষাঢ় – শ্রাবণ মাসে দেশি পাট ও ভাদ্র মাসে পাট কাটা হয় । দেশি পাট হেক্টরে ৪.৫ থেকে ৫.৫ টন ওতোষা পাট হেক্টরে ৪ থেকে ৪.৫ টন হয় ।
পাটের ব্যবহার :
উৎকৃষ্ট পাটের আঁশগুলো যেমন দীর্ঘ , তেমনি সূক্ষ্ম , চিকন ও রেশমের মতো সমুজ্জ্বল । পাট থেকে বিবিধ শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হয় ।জার্মানি , ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পাট দিয়ে কাপড় তৈরি হয় । আমাদের দেশেও পাট দ্বারা নানা রকমের দ্রব্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। পাটের ওপর ভিত্তি করেই এদেশের পাট শিল্প , কাগজ শিল্প ও কাপড় শিল্প গড়ে উঠেছে । পাট দ্বারা তৈরি পারটেক্স , চেয়ার , টেবিল , গেইট , বাড়ি – ঘর ডেকোরেশন ও বিভিন্ন প্রকার খেলনা তৈরি হচ্ছে । তাছাড়া পাট থেকে দড়ি , কাছি , চট , থলে , কাপের্ট , কম্বল প্রভৃতি দ্রব্য প্রস্তুত হয়ে থাকে । দৈনন্দিন জীবনে পাটের উপযোগিতা অপরিসীম ।
পাট ব্যবসা :
পাটের ব্যবসা খুবই লাভজনক । পাট উৎপাদন ও ব্যবসা করে এ দেশের অনেক লোক জীবিকা নির্বাহ করে । বৈদেশিক মুদ্রাঅর্জনে পাটই একমাত্র বাণিজ্যিক পণ্য ।
পাট শিল্পের সঙ্কট :
বর্তমানে পাটের বিকল্প কৃত্রিম আঁশ আবিষ্কার হওয়াতে বহির্বিশ্বে পাটের চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছে । যার ফলে আমাদের পাটশিল্প সঙ্কটজনক অবস্থায় পতিত হচ্ছে । সেই সাথে পাটের রপ্তানি কমে যাওয়ায় কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না । উপরন্তুআমাদের জাতীয় অর্থনীতির গতি হারাতে শুরু করেছে । একই সাথে আমাদের কৃষকরাও পাট উৎপাদনে উৎসাহ পাচ্ছে না ।এমতাবস্থায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করার লক্ষ্যে পাট শিল্পকে বর্তমান সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে হবে । পাটেরবহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে । সেই সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে আমাদের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের মানউন্নয়ন করতে হবে । পাটের বর্তমান অবস্থা । বর্তমানে নাইলন ও পলিথিন পাটের বাজার দখল করেছে । তাই দেশে বহু পাটকলইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে এবং বাকিগুলো বন্ধের পথে ।
সম্ভাবনা :
বর্তমানে বি.সি.আই.সি , ৪০ দিন বয়সের সবুজ পাট থেকে কাগজ তৈরির মণ্ড আবিষ্কার করেছেন । এ মণ্ড বাঁশ , আখের ছোবড়াও গাছ থেকে তৈরিকৃত মণ্ডের চেয়ে উন্নতমানের এবং দামেও সস্তা ।
পরিবেশ দূষণ :
পাট পচে পানিতে নানান ধরনের রোগ বালাইয়ের সৃষ্টি হয় । এ পানি পান করায় ম্যালেরিয়া , টাইফয়েড ও উদরাময় রোগের ঝুঁকিবেড়ে যায় । ফলে গ্রামের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয় ও মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
উপসংহার :
পাট এদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল । শিল্পক্ষেত্রে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম । বিভিন্ন বিচিত্র ক্ষেত্রে যেমন এর ব্যবহার , তেমনিবহু ক্ষেত্রে এর উপযোগিতাও অনেক বেশি । দেশ – বিদেশে অনেক গবেষণায় পাটের বিকল্প কৃত্রিম আঁশ বের করে নানা কাজেলাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে ।
কিন্তু উপযোগিতা ও মূল্যের দিক থেকে সেসব কৃত্রিম আঁশ পাটের সমকক্ষতা লাভ করতে পারেনি ।পটি এখনো বিশ্বে অপরাজেয় রয়ে গেছে । কিন্তু আমাদের পাট চাষিরা পাটের ন্যায্য মূল্য পায় না । ফলে সোনালি আঁশ পাটিবর্তমানে কৃষকের গলার ফাস হয়ে দাঁড়িয়েছে । এজন্য সরকারকে পাট চাষিদের দিকে সুনজর দেয়া একান্ত অপরিহার্য ।