বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ও এর প্রতিকার
ভূমিকা :
বেকার হলো সেই ব্যক্তি যার কাজ করার সামর্থ্য ও ইচ্ছা আছে কিন্তু কাজ নেই । অন্যভাবে বলা যায় জনসংখ্যা অনুপাতে দেশেরকর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে জনসংখ্যার সমস্যাই হলো বেকার সমস্যা বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই কিছু না কিছু বেকারসমস্যা রয়েছে । তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি , বিশেষ করে বাংলাদেশে ।
বেকারত্বে আমাদের দেশ :
বেকারত্ব আজ আমাদের জাতিকে চারদিক থেকে গ্রাস করেছে অক্টোপাসের মতো। এর বিধ্বংসী প্রভাবে আমাদের আশা – আকাঙ্ক্ষা পর্যদস্ত , রাষ্ট্রীয় উন্নতির পথ বাধাগ্রস্ত । দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে । সরকারি – বেসরকারি অফিস – কলকারখানায় চাকরির ক্ষেত্রে সীমিত আসনের জন্য শুরু হয়েছে ভীষণ প্রতিযোগিতা । এ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরেবেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিন যাপন করছে । তাই বেকার আজ গ্রামে – গঞ্জে , পথেঘাটে সর্বত্রই । কর্মহীন থাকায় এরা দিনেরপর দিন জড়িত হয়ে পড়ছে সন্ত্রাসী , নেশা ও যৌতুকের ন্যায় হীন কাজে । দেশ বঞ্চিত হচ্ছে সেবা থেকে । যৌবনে ভরা এজনশক্তি যেখানে হতে পারত দেশের জন্য সম্পদ , সেখানে তারা আজ দেশের বোঝা ।
বেকারত্বের কুফল :
বেকার সমস্যা তীব্র হয়ে উঠলেই দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয় । ফলে নানা প্রকার শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলাদেখা দেয় । শ্রমিক , কৃষক , চাকরিজীবী যখন শ্রমের বিনিময়ে অন্ন সংস্থানে অসমর্থ হয় , তখন স্পষ্টতই দেশে অর্থনৈতিক বন্টনআর সুষম থাকে না । এ অধিক জনশক্তি যখন উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে না , তখন উৎপাদন এমনিতেই হ্রাস পায় । তখনবিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে এই শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করা হয় । এর অপরিহার্য ফলস্বরূপ দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আসে ।অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে , প্রভাবশালী দেশগুলো বেকার সমস্যায় জর্জরিত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকপ্রভুত্ব কায়েম করে । ফলে সে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা যায় ।
বেকারত্বের কারণ :
বেকারত্ব এদেশের নতুন কোনো সমস্যা নয় । জানা যায় প্রাচীনকালেও নিঃস্ব , বেকার , শ্রমনির্ভর মানুষের অস্তিত্ব ছিল ।মধ্যযুগেও বেকারত্ব কম – বেশি ছিল । বর্তমানে এত অধিক বেকারত্বের অন্যতম কারণগুলােহ হলো
ক , দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে । জনসংখ্যার সাথে খাদ্যশস্য উৎপাদন বা কাজের সুযোগ বাড়ছে না , তাইবাড়তি মানুষ বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছে ।
খ , আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা কোনো বৈজ্ঞানিক জীবন পদ্ধতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় । সমাজ মূলত বুর্জোয়াশাসিত , আর অর্থনীতিও জনকল্যাণমুখী নয় । দেশের অর্থ – সম্পদ মূলত গুটি কয়েক লোকের হাতে জিম্মি । তাই প্রয়োজনীয়সংখ্যক কলকারখানা গড়ে উঠছে না , ফলে বাড়ছে না কাজের সুযোগ ।
গ . আমাদের দেশের পরিকল্পনা মূলত রাজনীতি নির্ভর । আর অস্থিতিশীলতা হলো আমাদের রাজনীতির উল্লেখযোগ্য দিক । এঅস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যের মধ্যে যেমন কোনো উন্নয়ন কাজ সফল হতে পারে না , তেমনি বৈদেশিক কোনো বিনিয়োগকারীপ্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে না । ফলে নতুন কোনো কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় না ।
ঘ . আমাদের চাকরি নির্ভরতাও বেকারত্বের একটি অন্যতম কারণ। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও একজন যুবক একটিসরকারি চাকরির আশা হন্যে হয়ে ছুটছে । মূলত , আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবমুখিতার অভাবই এর কারণ।শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টঅচলাবস্থাও আমাদের বেকারত্বের জন্য দায়ী।নানান জটের কারণে ছাত্র – ছাত্রীদের জীবন থেকে খসে পড়ছে মূলবান সময় ।দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকার ফলে তারা হারাচ্ছে কর্মস্পৃহা ও ত্মবিশ্বাস যা বেকারত্বকে সহায়তা করে ।
বেকার সমস্যা সমাধানের উপায় :
বাংলাদেশের বেকার সমস্যার সমাধানকল্পে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গৃহীত হতে পারে।
ক . জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে :
বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না । ফলে বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে ।জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারলে এবং শিল্পায়ন বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশ রক্ষা পেতেপারে ।
খ , কারিগরি শিক্ষার প্রসার :
দেশে যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটলে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হবে । এরা দেশে – বিদেশে উৎপাদনশীলখাতে খুঁজে পাবে কাজের অফুরন্ত সুযোগ । এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতেপারলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে ।
গ . কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণ :
দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে হস্তজাত কুটির শিল্প পণ্যের বিশাল বাজার ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে । কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণঘটানো গেলে বেকারত্ব লাঘবের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে । এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থাকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে ।
ঘ , কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি গ্রহণ :
প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ , প্রেরণা যোগান গেলে আমাদের তরুণ সমাজ স্বকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের আর্থ – সামাজিক উন্নয়নেগুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে । ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম স্থাপন , মৎস্য চাষ , নার্সারি , ফুল চাষ , সবজি চাষ , মৌমাছি – চাষপ্রভৃতি ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ দানের ব্যবস্থা করা ও আনুষঙ্গিক সরকারি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানকে বেকারত্বলাঘবের উপায় হিসেবে অবলম্বন করা যায় ।
ঙ . জনশক্তি রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ :
এশিয়ার মালয়েশিয়া , দক্ষিণ কোরিয়া , জাপান , ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ , যুক্তরাষ্ট্র , কানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ ওআধা – দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে । পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী গড়ে তুলে এবং সরকারি উদ্যোগেজনশক্তি রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ করলে আমাদের দেশ শুধু বেকারত্ব লাঘবেই সফল হবে না , প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরমাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অর্জন করতে পারবে ।
উপসংহার :
অতিরিক্ত জনসংখ্যা আর বেকারত্বের ভারে জর্জরিত আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ হয়ে জাতীয় উন্নয়নে মনোনিবেশকরা । অত্যন্ত আশার কথা শিক্ষিত বেকার যুবসমাজকে বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণদানের জন্য সরকার একটি অধিদপ্তর স্থাপনকরেছে । এভাবে তাদের মধ্যে কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি ও নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । এর অধীনে যুবক – যুবতীদেরকেআত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন কারিগরি কাজ হাতে – কলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে । প্রশিক্ষণ শেষে তারা আত্মকর্মসংস্থান করতেপারছে । এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বেকার যুব সমাজকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করছে