মাদকসক্তির অপকারিতা ও প্রতিকার
ভূমিকা :
মানুষের নেশা করার প্রবণতা বহু প্রাচীনকাল থেকে এসেছে । কিন্তু সাম্প্রতিককালে নেশা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণতহয়েছে এবং সারা বিশ্বে এটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । বর্তমান যুগকে মাদকাসক্তিরই যুগ বলা হয় । মাদকাসক্তি এমন একটিদুর্বার নেশা যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন । মাদক বা নেশার দ্রব্যের প্রতি মারাত্মক আসক্তিব্যক্তি জীবনে যেমন সর্বনাশ সৃষ্টি করছে , তেমনি জাতীয় জীবনকেও এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে ঠেলে দেয় ।
মাদকাসক্তির কারণ :
মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি একদিনে বা হঠাৎ করে হয় না । দিনে দিনে এর প্রতি আসক্তি জন্মায় । মাদকাসক্তি সমস্যাটির মূলেবহুবিধ কারণ রয়েছে । এর মধ্যে প্রধান প্রধান কারণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক . হতাশা :
মানুষ নিজেকে নিয়ে অনেক উচ্চ আশা পোষণ করে । এ আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তখন তার জীবনে হতাশা নেমে আসে ।সেই হতাশা থেকে মুক্তির জন্য সে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে ।
খ . চিরন্তন নতুনত্বের নেশা :
নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ মানব – চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । আর এ নতুনত্বের প্রতি অদম্য আগ্রহের কারণেই অনেকে একটু দেখি ‘ বলে মাদক গ্রহণ শুরু করে । মাদক এমনই জিনিস একবার ধরলে তা আর ছাড়া যায় না।
গ . পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব
অনেক সময় মাদকদ্রব্যের সাথে প্রায় অপরিচিত একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত বন্ধু বা সঙ্গীদেরপ্রভাবে নিজের অজান্তে মাদকদ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । এছাড়া প্রেমে ব্যর্থতা , ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা , মূল্যবোদের অভাব , হঠাৎ সঞ্চিত টাকার চাপ ও ব্যয়ের অপরিচ্ছন্ন পন্থা– এগুলো আমাদের তরুণসমাজকে মাদকাসক্ত হওয়ারপথ সুগম করে দেয় ।
মাদকাসক্তির প্রকারভেদ :
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য চালু আছে । মদ , গাঁজা , ভাং , আফিম ইত্যাদির নেশা বহু প্রাচীনকালের । বিজ্ঞানেরঅগ্রগতির সাথে সাথে মাদকদ্রব্যেরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে । বর্তমানকালের মাদকদ্রব্য হিসেবে হেরোইন , মারিজুয়ানা , এলএসডি, প্যাথেড্রিন , কোকেন , হাশিশ , মরফিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তবে আমাদের দেশের যুবসমাজ অতি সামান্য কারণে যেসবড্রাগকে মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করে তার মধ্যে– সিডাকসিন , ইনকটিন , প্যাথেডিন , হেরোইন , ফেনসিডিল ও ইয়াবা প্রধান ।
মাদকদ্রব্যের পাচার ও চোরাচালান :
মাদকদ্রব্য প্রসারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পাচার ও চোরাচালান । সুসংবদ্ধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বর্তমানে সারা পৃথিবীতেমাদকদ্রব্য চোরাচালানের জাল বিস্তৃত । মূলত বহু বিস্তৃত পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণকারী চক্রের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য পাচারে অর্থযোগান দেয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এ নেটওয়ার্ক সক্রিয় ।ভৌগৌলিক দিক থেকে মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও পাচারের জন্য আমেরিকা , কলম্বিয়া , পানামা ও মেক্সিকো ছাড়াও এশিয়ার তিনটিসীমান্ত পয়েন্ট ; যেমন –১ . গোল্ডেন ট্রায়েঙ্গেল– মায়ানমার , লাওস ও থাইল্যান্ড সীমান্ত ; ২. গোল্ডেন ওয়েজ আফগানিস্তান , পাকিস্তান ও ইরান সীমান্ত ; ৩. গোল্ডেন ক্রিসেন্ট – বাংলাদেশ , নেপাল ও ভারত সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়েছে ।
মাদকাসক্তির ক্ষতিকর দিক :
মাদকাসক্তির কারণে মানুষের কর্মশক্তি লোপ পায় ও আয়ু কমে যায়।যার প্রভাব ব্যক্তিগত , পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেপরিলক্ষিত হয় এবং নানা সমস্যার সৃষ্টি করে । মাদকাসক্তির প্রভাবে যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতন ঘটে । নেশাগ্রস্তদের মধ্যেবাড়ে অপরাধপ্রবণতা । তারা স্বাভাবিক সুখ – স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনকে বিসর্জন দিচ্ছে । অনেকে অকালে মৃত্যুবরণ করছে ।গবেষণায় দেখা গেছে , মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে । মাদকাসক্ত ব্যক্তি নেশারখরচ যোগানোর জন্যই নানা রকম সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। মাদকদ্রব্য মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে , তার ব্যক্তিত্বনষ্ট হয় , স্বাভাবিক জীবনে বেঁচে থাকার শক্তির থাকে না।
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার:
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ন্যায় আমাদের দেশেও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশেষ করেআমাদের তরুণসমাজ আজ ভয়াবহ মাদকসক্তির শিকার । বাংলাদেশে কী পরিমাণ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হয় এবং কত লোকমাদকাসক্ত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই । তবে এদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে বলেবিশেষজ্ঞদের ধারণা । বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সরাসরিভাবে নিষিদ্ধ হলেও ওষুধ তৈরির কাঁচামালহিসেবে কিছু কিছু মাদকদ্রব্য আমদানি করার অনুমতি রয়েছে । এ সুযোগে চোরাকারবারি ও কালোবাজারি শুল্ক ফাকি দিয়েবিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য আমদানি করছে এবং উচ্চমূল্যে তা তুলে দিচ্ছে তরুণ – তরুণীদের হাতে । ফলে এদেশে প্রচুর পরিমাণেমাদকদ্রব্যের অপব্যবহার হচ্ছে । আমাদের দেশের মাদকাসক্তদের অধিকাংশই যুবক – যুবতী , উঠতি বয়সের তরুণ– তরুণী ।মাদকদ্রব্য চোরাচালানের যাত্রাপথে বাংলাদেশের মানচিত্র অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ সমস্যা আমাদের সমাজে দিন দিন তীব্র থেকেতীব্রতর হচ্ছে।
প্রতিকার :
মাদকদ্রব্যের এ সর্বনাশা ব্যবহারের গতিরোধ করা একান্ত আবশ্যক । এ সমস্যার মোকাবিলা নিম্নলিখিতভাবে করাযেতে পারে
১. মাদকদ্রব্য চোরাচালান প্রতিরোধ কর্মসূচিকে আরো জোরদার করতে হবে।
২. ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে হবে এবং বেকারত্বের অবসান ঘটানোসহ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উজ্জ্বলধারণা দিতে হবে।
৩. তরুণসমাজ যাতে জীবন গঠনের আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয় সে জন্য অভিভাবক , শিক্ষক , সমাজসেবক ওরাজনীতিবিদসহ সকলকে সচেতন হতে হবে।
৪. মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণতির কথা সংবাদ মাধ্যম ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে প্রচার করতে হবে । ৫ সর্বোপরিমাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে ।
উপসংহার :
মাদকাসক্তির মতো সর্বনাশা মরণ ছোবল আজ দেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । আজকের ওআগামী দিনের সুস্থ , সুন্দর ও সুখকর সমাজের জন্যই এ মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধ করতৈ হবে । আর এর জন্য প্রয়োজনব্যক্তিগত উদ্যোগ , সামাজিক প্রতিরোধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ । অবশ্য এ ব্যাপারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেনানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে , যা কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে।