মানুষের ইতিহাস প্রাচীন যুগ PDF by নূরুন নাহার বেগম

বইয়ের নাম |
মানুষের ইতিহাস ( প্রাচীন যুগ ) |
লেখক |
নূরুন নাহার বেগম |
প্রকাশনী |
আগামী প্রকাশনী |
পেজ |
287 |
দেশ |
বাংলাদেশ |
ভাষা |
বাংলা |
এই বইয়ে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার কথা বলা হয়েছে। গ্রীক ও রোমান সমাজব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে রয়েছে। মূলত রোমানসাম্রাজ্যের পতনের কথা বলে লেখকদ্বয় প্রাচীন যুগের গল্প শেষ করেছেন।
ভূমিকা‘
মানুষের ইতিহাস ‘ গ্রন্থে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির সভ্যতার ও সংস্কৃতির ইতিহাস লিখিত হয়েছে । সাধারণভাবে যাকেপৃথিবীর ইতিহাস বা সভ্যতাবলীর ইতিহাস নামে অভিহিত করা হয় , এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু তাই । তথাপি ‘ যে একে মানুষের ইতিহাসবলা হল তার বিশেষ কারণ আছে । মানবসমাজ এক ও অখও । একদা ইউরোপের উপনিবেশবাদী পণ্ডিত – সমাজ প্রচারকরতেন যে , এশিয়া , আফ্রিকা , অষ্ট্রেলিয়ার কৃষ্ণ ও পীতকায় মানুষরা শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের মানুষ । পৃথিবীরসব দেশের মানুষ একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত । আধুনিক কালের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব সুশিক্ষিত ইতিহাসবিদ এবং পণ্ডিতইবিশ্বাস করেন যে সমগ্র মানবসমাজ এক ও অখণ্ড এবং পৃথিবীর শিক্ষিত ও পণ্ডিতসমাজে এ ধারণাও ক্রমশ প্রসার লাভ করছেযে মানব সমাজের ইতিহাস , অখও ও অবিভাজ্য । অবশ্য এ কথাটার নানা রকম ব্যাখ্যা হতে পারে ।
আধুনিক মানবসমাজের উৎপত্তি হয়েছিল একটা মাত্র উৎস থেকে । আদিম এ মানুষদের সংস্কৃতি ছিল পুরান পাথর যুগেরশিকারী সমাজের সংস্কৃতি । এ যুগে মানুষ তার সামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজেদের দেহের বিবর্তন ঘটিয়ে যে সুসম্পূর্ণমানব দেহের উদয় ঘটিয়েছিল , আধুনিক পৃথিবীর সব কটি জাতির প্রত্যেকটি মানুষ সে সুপরিণত মানবদেহেরই উত্তরাধিকারীমাত্র । আদিম শিকারী মানুষ যে সমাজ সংগঠন এবং বস্তুগত ও ভাবগত সংস্কৃতি সৃজন করেছিল তার অনেক উপাদানেআজকের পৃথিবীর সব কটি জাতির ও সমাজের মূল ভিত্তিরূপে কাজ করছে ।
আদিম মানুষ যে ভাষার উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল সে ভাষা ও চিন্তাক্ষমতা , তার উদ্ভাবিত প্রেম , প্রীতি , ভালবাসা প্রভৃতি মানবিকগুণাবলী এবং নানাবিধ সামাজিক আচরণ ইত্যাদি আজকের দিনের সব মানবগোষ্ঠীর সামাজিক আচরণের মূল ভিত্তিরূপেবিরাজ করছে । আজকের পৃথিবীর সব মানুষ ও জাতি এ অচ্ছেদ্য যোগসূত্র ও বন্ধনে আবদ্ধ । আদিম শিকারী সমাজের মানুষহাজার হাজার বছর ধরে ক্রমশ সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল । তারপর দশ হাজার বছর আগে যখন পশ্চিম এশিয়াতেকৃষিভিত্তিক সমাজের উৎপত্তি ঘটেছিল তখন সে সংস্কৃতিও সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছিল । এ দুই সমাজের সংমিশ্রণেরমধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাজের বিকাশ ঘটেছিল । কিন্তু এ সকল মানব সমাজ কখনও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল না ।
ছয় সাত হাজার বছর আগে যখন মিশর ও ব্যাবিলনে ব্রোঞ্জযুগের নগর সভ্যতার উদয় ঘটেছিল তখন ক্রমশ তার প্রভাবে ওঅনুকরণে পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে এবং সিন্ধু অববাহিকায় , চীনে ,ভূমধ্যসাগরের ক্রীটে বোঞ্জযুগের সভ্যতাগড়ে উঠেছিল । এরপর ব্রোজঞ্জযুগের বিভিন্ন অঞ্চলের নানাবিধ আবিষ্কার , ব্যবসা – বাণিজ্যের প্রসার , প্রভৃতির সুযােগ ওপ্রভাব লাভ করার ফলে হিটাইটরা লােহার আবিষ্কার করেছিল , ফিনিশীয়রা বর্ণমালা আবিষ্কার করেছিল এবং লিডীয়রা মূদ্রাআবিষ্কার করেছিল । এ সবের ভিত্তিতে গ্রীসে ও অন্যত্র গড়ে উঠেছিল লৌহযুগের উন্নত সভ্যতা ।
এ সভ্যতার নানা বস্তুগত আবিষ্কার , উপকরণ ও চিন্তাধারা আবার পৃথিবীতে অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে । আবারমধ্যযুগে চীন , ভারতবর্ষে যে সব আবিষ্কার ঘটেছে ( যথা , চীনের কম্পাস ইত্যাদি ; প্রাচীন ভারতের ১০ – ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি ) তার ভিত্তিতে ইউরােপে ধনতান্ত্রিক সমাজের উদয় ঘটেছিল । মানুষের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে এ কথা স্পষ্ট দেখা যায় যে , সবযুগেই এক 1 জাতি অপর জাতির কাছে থেকে বা বৃহত্তর মানব সমাজের কাছ থেকে বস্তুগত ও ভাবগত সম্পদ ও উপকরণ সংগ্রহকরে নিজেদের পুরিপুষ্টি সাধন করেছে এবং মানব সমাজের অগ্রগতিতে সহায়তা করেছে ।
মানুষের ইতিহাস তাই মানব সমাজের অখণ্ড ইতিহাস । কিন্তু মানব সমাজ অবিভাজ্য একথা যেমন সত্য , মানব সমাজ খণ্ড খণ্ডও বিচ্ছিন্ন এ কথাও সমান সত্য । পৃথিবীর সব মানুষ মূলত এক হলেও তারা বিভিন্ন দেশ ও জাতিসত্তার অন্তর্গত । মানুষেরইতিহাস মূর্ত হয়েছে , বাস্তবায়িত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও দেশের পরিসরে । মানুষের ইতিহাস তাই ভিন্ন ভিন্ন জাতির খণ্ডিতইতিহাসের যােগসমষ্টিও বটে । প্রথমেই মানুষের উৎপত্তি ও আদিম সমাজের পরিচয় আমরা বিস্তৃতভাবে প্রদান করেছি , যাতেপরবর্তী সভ্য সমাজের উৎপত্তির পটভূমি অনুধাবন করা সহজ হয় ।
( জড়জগৎ ও জীবজগতের বিবর্তনের পটভূমিতে মানুষের উ ৎপত্তির বিষয় আলোচনা করলে আরও ভাল হত ; তবে , আবদুলহালিমের লেখা ‘ বিশ্বজগতের পরিচয় ‘ গ্রন্থটি পাঠ করলে এ বিষয়টা আরও বিস্তৃত ভাবে জানা যাবে । আদিম সমাজের পরবর্তীপর্যায়ে সব সমাজের ইতিহাসকে বিভিন্ন দেশ ও জাতির ইতিহাসরূপে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে । যেমন , ব্রোঞ্জ ওলৌহযুগের মিশরীয় , মেসোপটেমিয়া ( সুমেরীয় , ব্যবিলনীয় , আসিরীয় , ক্যালডীয় ) , পারসিক , হিব্রু , হিটাইট , ফ্রিজীয় , লিডীয় , ফিনিশীয় , ক্রীটীয় , গ্রীসীয় , রােমক , ভারতীয় , চৈনিক , কোরীয় , জাপানী , মায়া , আজটেক , ইনকা প্রভৃতি সভ্যতা– সংস্কৃতির পরিচয় পৃথকভাবে দেওয়া হযেছে ।
আবার বিভিন্ন সভ্যতা সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ ও প্রভাবের বিষয়ও যতদূর আবিষ্কৃত হয়েছে তার উল্লেখ করা হয়েছে ।যেমন , অষ্ট্রেলিয়া ও ওশেনিয়ার আদিবাসী , আফ্রিকার কৃষ্ণ অধিবাসী , ইউরেশিয়ার বর্বর সমাজ ( শক , হুন , মোঙ্গল , স্লাভ , গথ , ভ্যাণ্ডাল , ভাইকিং ) ইত্যাদির ইতিহাস আলোচনা করা হযেছে তৎকালীন বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে । উল্লেখ্য যে , বর্তমানখণ্ডে প্রাচীন যুগের অবসান ( প্রায় খৃষ্টীয়………পঞ্চম শতাব্দী কাল ) পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস বর্ণিত হযেছে । বস্তুত , ইতিহাস – জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না ।
বিশুদ্ধ বা বিমূর্ত জ্ঞান লাভের প্রয়োজনে মাত্র নয় , সমসাময়িক বিশ্বে নিজের এবং স্বদেশের অবস্থান জানার জন্য , স্বদেশ বাসংস্কৃতির বিকাশ সাধনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য মানুষের ইতিহাস অধ্যয়ন করা আবশ্যক । উন্নত দেশের ছাত্র – ছাত্রীরা স্কুলজীবনেই পৃথিবীর ইতিহাস পাঠ করে থাকে , মানব সভ্যতার ইতিহাস ঐ সব উন্নত দেশের স্কুলের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ।গ্রন্থপঞ্জীতে প্রদত্ত প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ ছাড়াও আরও অজস্র গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে সর্বাধুনিক আবিষ্কৃত তথ্যসমূহ সংগ্রহ করে সহজবোধ্যও সুশৃঙ্খলভাবে বর্তমান গ্রন্থে উপস্থাপিত করা হয়েছে ।
বক্তব্যকে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান করে তোলার জন্য বহুসংখ্যক ছবি ও মানচিত্র এ পুস্তকে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে ।…….. লেখক হিসেবেআমরা চেষ্টা করেছি যাতে বইটি বিষয়বস্তুর বিচারে উৎকৃষ্ট মানের হয় এবং ব্যাপক সংখ্যক পাঠকের পক্ষে সহজবোধ্যও হয় । এবইয়ের ভাষা ও যুক্তি – বিশ্লেষণ এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছে । যাতে সপ্তম অষ্টম শ্রেণীর কিশোর অথবা অল্প শিক্ষিত বয়স্ক – শ্রমজীবী বা কর্মজীবীর পক্ষেও এ বই বুঝতে কোন অসুবিধা না হয় । আবার উচ্চশিক্ষিত পাঠক , এমন কি , ইতিহাসের ছাত্রএবং শিক্ষক – অধ্যাপকগণও যাতে আগ্রহবোধ করতে পারেন এমন তথ্য ও বিশ্লেষণ এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে । বইটি যদিব্যাপক পাঠক সমাজে সমাদর লাভ করে তাহলেই পরিশ্রম সার্থক বিবেচনা করব ।
আবদুল হালিম
নূরুন নাহার বেগম
পুরান পাথর যুগের শিকারীসমাজ পৃথিবীতে সব কিছুই পরিবর্তনশীল , রূপান্তরশীল । জগতের পরিবর্তন আছে , রূপান্তর আছে, তাই তার একটা ইতিহাস আছে । যদি জগৎ স্থবির হত , পরিবর্তনহীন হত , তবে তার কোনো ইতিহাস থাকত না । ইতিহাসকথাটার মধ্যেই তাই একটা গতিময়তার ধারণা নিহিত রয়েছে । ইতিহাস অর্থ পরিবর্তনের ইতিহাস , রূপান্তরের ইতিহাস । মানবসমাজের ইতিহাস সম্পর্কে কথাটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য । মানুষের ইতিহাস বলতে তাই কতগুলো তাৎপর্যহীন , সম্পর্কহীন ঘটনারবিবরণমাত্র বোঝায় না ; তার রূপান্তরের , তার প্রগতিশীল বিকাশের বিবরণকেই বোঝায় । মানুষের ইতিহাস লিখতে গেলে তারউৎপত্তির কাহিনী দিয়েই শুরু করা দরকার ।
কিন্তু এখানে একটা অসুবিধা আছে । আজকের পৃথিবীতে যে মানুষ বাস করছে , এ জাতের মানুষের আবির্ভাব পৃথিবীতেঘটেছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চ হাজার বছর আগে । তার আগের অন্য এক অসম্পূর্ণ মানুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিকমানুষের উদ্ভব হয়েছিল এবং তা ছিল এক দীর্ঘকালব্যাপী প্রক্রিয়া । আবার এ পরিবর্তনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল , যাপ্রাণিজগতের বিবর্তন থেকে পৃথক । মানুষের আগের অর্থাৎ মানুষের চেয়ে নিম্নতর পর্যায়ের সব প্রাণীর বিবর্তন ঘটেছে প্রাকৃতিকপরিবেশের প্রভারে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখে ।
এভাবেই নতুন নতুন দেহ – বৈশিষ্ট্য অর্জন করে একটা প্রাণী অন্য একটা প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হয় । যেমন মাটিতে যে সবপ্রাণী বাস করে তাদের পক্ষে মাথার দুপাশে চোখ থাকা সুবিধাজনক । তার ফলে তারা সহজে চারপাশে দৃষ্টি রাখতে পারে , সহজেশত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে । কিন্তু প্রায় সাত কোটি বছর আগে মুষিকজাতীয় একরকম স্তন্যপায়ী প্রাণী যখন গাছেবাস করতে শুরু করল , তখন মুখের দুপাশে চোখ থাকাটা অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াল ।
কারণ , গাছের ডালে চলাফেরার সময় ভারসাম্য রক্ষার জন্য সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ । রাখাই বেশি দরকার । মুখের সামনেদুটো চোখ থাকলে কোনো জিনিসের উপর দুই চোখের দৃষ্টি একসাথে ফেলা সম্ভব হয় । আর তার ফলে কোন জিনিসটা কাছেকোনটা দূরে অথবা একটা জিনিসের বেধ বা গভীরতা কতখানি তা বোঝা সম্ভব হয় । বৃক্ষবাসীদের পক্ষে এ গুণটা বিশেষদরকারী ।
এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে যেতে হলে সেটা কত দূরে আছে তা নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারা চাই । একাজটাবানররা সহজেই করতে পারে , কারণ তাদের চোখ দুটো মুখের সামনের দিকে এবং দুই চোখে তারা একই জিনিসের যে দুটো চিত্রদেখতে পায় , তাদের মগজে গিয়ে সেগুলো একত্রিত হয়ে একটা চিত্রে পরিণত হয় । অপরপক্ষে , শুধু এক চোখে দেখলেচারপাশেরজিনিসকে মনে হয় কাগজে আকা ছবির মতো।
এক চোখওয়ালা মানুষ তাই সহজে স্থির করতে পারে না দুটো জিনিসের মধ্যে কোনটা কাছে কোনটা দূরে । অনেককাল আগে , চার – পাঁচ কোটি বছর আগে , এক জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণী গাছে বাস করার ফলে ঐ পরিবেশের উপযোগী কতগুলো গুণ অর্জনকরেছিল , যা ভূমিচর প্রাণীদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়নি । এ জাতের প্রাণীদের বলা হয় প্রাইমেট । অতীতকালের প্রাইমেটদেরএকটি শাখা থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে । প্রাইমেটদের অন্যান্য শাখার প্রাণীরা বার অথবানরবানর গেরিলা , শিম্পাঞ্জী ইত্যাদি ) পর্যায়েই আটকে আছে । গাছে চলার পক্ষে তীক্ষ্ণ বাঁকানো নখর বাধাস্বরূপ বলে প্রাইমেটরাক্রমে চ্যাপ্টা নখ অর্জন করল । গাছের ডাল আকড়ে ধরতে সুবিধা বলে প্রাইমেটরা ক্রমশ অর্জন করেছে এমন আঙুল , যাস্বতন্ত্রভাবে নাড়ানো চলে এবং তার বুড়ো আঙুল অন্যান্য আঙুলের উল্টোদিকে এমন আলাদা ভাবে অবস্থিত যে , তার ফলে যেকোনো জিনিসকে মুঠ করে ধরা যায় । গাছে বাস করার ফলে প্রাইমেটদের মাংসপেশি , ইন্দ্রিয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে ।
প্রাইমেটদের মগজের ক্রমবিকাশ । ( ক ) শিম্পাঞ্জী ( খ ) অষ্ট্ৰালোপিথেকাস মানুষ ( গ ) খাড়া মানুষ ( পিকিং ও জাভা মানুষ ।করােটির ভিতরে কালো রঙে মগজের আকার দেখানো হয়েছে । লক্ষণীয় যে , মগজের আয়তন যত বৃদ্ধি পেয়েছে , চোয়ালেরআকার ততই তুলনামূলকভাবে ছোট হয়ে এসেছে । গাছের ডালে যারা বাস করে তাদের জগৎ মাটির প্রাণীর মতো স্থির নিশ্চলজগৎ নয় ।
গাছের ডাল সব সময়েই দুলছে , আন্দোলিত হচ্ছে , কখনও প্রাণিদেহেরই ভারে । এ চিরচঞ্চল জগতে থাকতে গেলে সব সময়ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয় , দ্রুত চিন্ত করতে হয় । স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটাতে হয় । পরিবেশের দিক থেকে এ রকম সহায়তপাওয়ার ফলেই প্রাইমেটরা কালক্রমে বড় মগজের অধিকারী হয়েছে । প্রাইমেটদের একটা শাখা যখন গাছ থেকে নেমে এল এবংবিবর্তনের মাধ্যমে মানুষে পরিণত হল তখনও তার মধ্যে প্রাইমেটদের ঐ সকল গুণ ( বিশেষ ধরনের চোখ – জোড়া , হাত মগজ ) রয়েই গেল এবং আরও বিকাশ লাভ করল । প্রাইমেটদের অন্যান্য শাখার প্রাণীর মধ্যেও প্রাইমেটদের ঐ সকল গুণ রয়ে গেছে ।এ কারণেই বানর , গরিলা ও মানুষের মধ্যে কতগুলো আশ্চর্য মিল রয়েছে । এখানে একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার ।পরিবেশের প্রভাবে প্রাণী নতুন নতুন প্রয়োজনীয় গুণ অর্জন করে , কথাটার মানে কি ? দরকার হলেই কি কেউ তীক্ষ্ণ বাঁকানোনখর বাদ দিয়ে চ্যাপটা নখ অর্জন করতে পারে ; অথবা মুখের দুই পাশ থেকে চোখকে ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে আসতেপারে : তা কেউ পারে না । সাধারণভাবে অবশ্য একথা ঠিক যে , পিতামাতার মধ্যে যে দৈহিব গুণ থাকে , সন্তান তা লাভ করে । এপ্রক্রিয়ার নাম বংশগতি । এ কারণেই মানুষের সন্তান তার পিতামাতার অনুরূপ হয় , ভালুকের সন্তান ভালুকের মতোই হয় । তবেপিতামাতার প্রায় অনুরূপ হলেও কোনো সন্তানই ঠিক তার পিতামাতার মতো হয় না , খানিকটা পার্থক্য থাকেই । এ পার্থক্যথেকেই পরিবর্তনের বা বিবর্তনের শুরু । তবে প্রাণিজগতে বিবর্তন শুধু একটা প্রাণীর দ্বারা ঘটে না , এর জন্য একদল প্রাণীরদরকার হয় । মনে করা যাক , বৃক্ষবাসী একদল প্রাইমেটের মধ্যে একটা প্রাইমেটের ক্ষেত্রে চোখ দুটো খানিকটা সামনের দিকেএগিয়ে এল । এ প্রাইমেটের সন্তানরাও ঐ রকম চোখবিশিষ্ট হবে ।
কয়েক পুরুষ পরে দেখা যাবে ঐ দলের মধ্যে কয়েক শ ‘ প্রাইমেট রয়েছে , যাদের চোখজোড়া খানিকটা সামনের দিকে । গাছেরউপর এ ধরনের চোখওয়ালা প্রাইমেটদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি বলে এরা বেশি বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকবে এবং দু‘পাশেচোখওয়ালা প্রাইমেটরা ( গাছ থেকে পড়ে । বেশি বেশি সংখ্যায় মারা যেতে থাকবে । কিছুকাল পরে দেখা যাবে , জীবনসংগ্রামেপরাজিত হয়ে মুখের দুপাশে চোখওয়ালা প্রাইমেটরা লুপ্ত হয়েছে আর মুখের সামনের দিকে চোখওয়ালা প্রাইমেটরা তাদের স্থাননিয়েছে ।
এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রাকৃতিক নির্বাচন , কারণ প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক পরিবেশ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে জীবনসংগ্রামে জয়ীপ্রজাতিসমূহ বেঁচে থাকে । জীবনসংগ্রাম মানে অবশ্য হাতাহাতি মারামারি নয় । যারা প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুরূপ দেহবৈশিষ্ট্যলাভ করে তারা জীবনসংগ্রামে জয়ী হয় । যাদের দেহবৈশিষ্ট্য প্রকৃতির আনুকূল্য লাভ করে না তারা জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয় ।তবে পরাজিত হলেও এরা সব সময় লুপ্ত নাও হতে পারে , হয়তো কষ্টে বা অপ্রধান হয়ে বেঁচে থাকে ।
উপরে যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হল , তা থেকে বোঝা যাবে সামগ্রিকভাবে দেখলে সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে , নতুন পরিবেশেরপ্রভাবে বৃক্ষবাসী প্রাইমেটরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ক্রমশ নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাতে শুরু করল । প্রজাতি বলতেবোঝায় একই জাতীয় প্রাণীদের , যারা নিজেদের মতো সন্তানের জন্ম দিয়ে বংশবিস্তার করতে পারে । যেমন , সমস্ত মানুষ একপ্রজাতির প্রাণী , সব গরু এক প্রজাতির প্রাণী , ইত্যাদি । মানুষের উৎপত্তির আগে পর্যন্ত প্রাণিজগতে বিবর্তন ঘটেছে প্রাকৃতিকপরিবেশের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে । কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এসে দেখা যায় মানুষ নিজেদেরকার্যকলাপ দ্বারা নিজেরাই বিবর্তন ঘটাচ্ছে । যদিও মাত্র চল্লিশ কি পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আধুনিক ধরনের মানুষের উৎপত্তিহয়েছে ( যে মানুষ মস্তিষ্কের ক্ষমতা বা হাতের কাজের দক্ষতার দিক থেকে ঠিক আমাদের মতোই । ছিল ) , তথাপি তার আগে দশপনের বা কুড়ি লক্ষ বছর আগেকার আধা – মানুষদের আমরা মানুষের হিসাব থেকে বাদ দিতে পারি না । কারণ গত দশ পনেরলক্ষ বছর ধরে আধা – মানুষরা দলবদ্ধ সমাজবদ্ধ কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের দৈহিক বিবর্তন ঘটিয়েছে এবং তার ফলে প্রায়পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আধুনিককালের সুসম্পূর্ণ মানুষের উদয় ঘটেছে ।
শুধু দৈহিক গুণাগুণের বিচার করলে আমরা হয়তো তাদের মানুষের হিসাব থেকে বাদ দিতে পারতাম , কিন্তু সামাজিককার্যকলাপের দিক দিয়ে বিচার করলে আধা – মানুষদেরও মানুষ বলতে হয় । গত পাঁচ দশ লক্ষ বছর ধরে অসভ্য পর্যায়ের আধা– মানুষরাযেসব দৈহিক ও মানসিক গুণ অর্জন করেছে তার ফলেই আধুনিক মানুষের উদয় সম্ভব হয়েছে , এ কথা তো সত্যি বটেই।………………………….।
PDF link: here