মহাস্থানগড় / বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন
ভূমিকা :
একটি দেশের পুরাকীর্তি সেই দেশের অতীতকালের সাক্ষ্য বহন করে । দেশটি কত উন্নত ছিল , তার কৃষ্টি – সংস্কৃতি কত উৎকর্ষলাভ করেছিল , সে সম্পর্কে সে দেশের পুরাকীর্তি যে সাক্ষ্য তুলে ধরে তার ওপর ভিত্তি করে সে দেশের সভ্যতার মান নির্ণীত হয় ।এমনি একটি পুরাকীর্তির পরিচয় বহন করে আমাদের দেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় ।
অবস্থান :
বগুড়া জেলার ইতিহাস – প্ৰসিদ্ধ করতোয়া নদীর তীরে এবং ঢাকা – দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে এই ঐতিহ্যবাহী মহাস্থানগড়অবস্থিত । সমতল ভূমি থেকে এর গড় উচ্চতা প্রায় ২০–২৫ ফুট । প্রাচীন যুগের বহু ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান । বিভিন্ন সময়খনন করে এ গড় থেকে পাথর , মূর্তি , শিলা , ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন আমলের মুদ্রা পাওয়া যায় । মহাস্থানগড় যে পুরাকীর্তিরএকটি অন্যতম নিদর্শনস্থল তা স্পষ্ট বোঝা যায় ।
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস :
অতি প্রাচীনকালে ‘ পুরাজ্য ‘ নামে এক রাজ্য ছিল । এই পুরাজ্যের সীমানার মধ্যে ছিল রংপুর , দিনাজপুর , পাবনা , রাজশাহী , বগুড়া , বালুরঘাট , মালদহ , কুচবিহার প্রভৃতি স্থান । এই রাজ্যে এক এক সময় এক এক রকমের নামকরণ করা হয়েছিল ।কখনাে হয়েছিল বরেন্দ্রভূমি , কখনো বা গৌড়রাজ্য । উত্তর বঙ্গের নাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন । রামায়ণ – মহাভারতেও পুণ্ড্রবর্ধনের নামউল্লেখ আছে । শশাঙ্ক নামে এক বাঙালি রাজা এক সময় পুরাজ্য দখল করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন । তিনি মালদহ জেলারগৌড়ে প্রধান রাজধানী স্থাপন করেন । তখন পুণ্ড্রবর্ধন প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে । পরশুরাম নামে একহিন্দুরাজা পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা । ছিলেন । ইতিহাস – বিখ্যাত মহাস্থানগড় রাজা পরশুরামের আমলেই সমৃদ্ধি লাভ করে ।মহাস্থানগড় ছিল করতোয়া নদীর তীরে একটি মনোরম স্থান । এ স্থানটিকেই রাজা পরশুরাম রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করতেন ।হিজরী ৪৪০ সনে হযরত শাহ সুলতান ইব্রাহিম বলখী মাহীসওয়ার ( র ) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেন ।অতঃপর ধাপ – সুলতানগঞ্জ নামক স্থানে তিনি আস্তানা । স্থাপন করেন । এখানে ইসলাম প্রচারের সময় তাঁর সঙ্গে রাজাপরশুরাম ও তাঁর ভগ্নি শীলাদেবীর ভীষণ যুদ্ধ হয় । যুদ্ধে রাজা পরশুরাম নিহত হন এবং তাঁর ভগ্নি শীলাদেবী মন্দিরের পেছনদরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে করতোয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন । এর ফলে এখানকার অগণিত লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণকরে । ৪৪৭ হিজরী সনে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার ( র ) এখানে ইন্তেকাল করেন । এখানে তার মাজার রয়েছে । সুলতানসাহেবের মাজারের নিচেই তার প্রধান খাদেমের কবর রয়েছে । এখানে আরেকজন দরবেশের মাজার আছে , তার নাম ছায়াতপুর। গড়ের একটু দক্ষিণে দরবেশে বোরহান উদ্দিনের মাজার । তারপর গোকুলের ম্যাড , বেহুলা সুন্দরী ও লক্ষ্মিন্দরের বাসর ঘরেরধ্বংসাবশেষ ; পশ্চিমে কালিদহ সাগর ও বাসোনিয়া সওদাগরের বাড়ি , উজানি – ভাইটালি নগর । এছাড়া উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে– শীলাদেবীর ঘাট ও রাজা পরশুরামের সভাগৃহের ধ্বংসাবশেষ । শীলাদেবীর ঘাট হিন্দুদের তীর্থস্থান । এখানে প্রতি বছর মেলা বসেএবং গঙ্গাস্নান করা হয় । পরশুরাম রাজার জীয়তপ একটি আশ্চর্যজনক কূপ । কথিত আছে যে , এ কূপের পানি দিয়ে নাকি মৃতব্যক্তিকে বাঁচানো যেত । বস্তুতপক্ষে , শীলাদেবীর জন্যেই আজ মহাস্থানগড় হিন্দুদের তীর্থস্থান এবং শাহ সুলতানের জন্যেমুসলমানদের অন্যতম পবিত্র স্থান । মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ :
১। বৈরাগীর ভিটা :
মহাস্থানগড়ে পাল আমলের বৈরাগীর ভিটা নামক দুটি বড় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে । বৈরাগীর ভিটা পটি তিনশ ‘ ফুট দীর্ঘ এবং ছাব্বিশ ফুট প্রস্থ । চারদিকের সমতল ভূমি থেকে উচ্চতা দশ ফুট । মন্দিরগুলো ছিল কারুকার্য খচিত ইট নির্মিত যাসহজেই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয় । বৈরাগীর ভিটার কিছু দূরে বহুকক্ষবিশিষ্ট একটি মন্দির রয়েছে । মন্দিরের মাঝ দিয়েস্নানাহীদের চলাচলের পথ । এখানে রাজকীয় অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পাদিত হতো।
২। মুনীর ঘোন :
শীলাদেবীর ঘাট সংলগ্ন মুনীর ঘোন ’ নামে একটি দুর্গ প্রাচীর রয়েছে । দুর্গটি উত্তর – দক্ষিণে প্রায় ১০০ ফুট লম্বা । উচ্চতা ১০ফুট এবং চওড়া প্রায় ১১ ফুট । অনুমান করা যায় যে , দুর্গ প্রাচীরটি পাল যুগে নির্মিত হয়েছে । প্রত্ন বিশেষজ্ঞদের ধারণা , এ দুর্গপ্রাচীরটি নদীপথের ওপর দৃষ্টি রাখার জন্য প্রহরীদের সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছিল ।
৩। গোবিন্দ ভিটা :
গোবিন্দ ভিটার মন্দির মহাস্থানগড় দুর্গ প্রাচীরের বহির্দেশে উত্তর পাশে অবস্থিত । গোবিন্দ ভিটা বিষ্ণুমন্দির ‘ নামে পরিচিত ।এটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে গুণ্ডামলে গড়ে তোলা হয় । গোবিন্দ ভিটার মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে ছিল দেবী । গোবিন্দভিটা প্রাচীন বাংলার অন্যতম কারুকার্য খচিত স্থাপত্যের নিদর্শন । এ ভিটায় তাম্র – ব্রোঞ্জের বিভিন্ন প্রকার অলঙ্কার , পোড়ামাটির মূর্তি এবং বিভিন্ন তৈজসপত্র পাওয়া গিয়েছে ।
৪। খোদার পাথর ভিটা :
খোদার পাথর ভিটার স্থানীয় নাম খোদার পাথর ঢিবি।তবে পূর্বে এর নকশা দেখে নামকরণ করা হয়েছিল । খোদার পাথর ঢিবি ।মূলত এটি হচ্ছে বৌদ্ধ মন্দিরের এক ধ্বংসাবশেষ যা ছিল পূর্বমুখী । গোটা মন্দিরটি অবশ্য ২৪ ফুট x ১৫ ফুট আয়তনের । এরমাঝে যে পাথরের আবিষ্কার হয় তার আয়তন ৯ ফুট ৪ ইঞ্চি x ২ ফুট ৪ ইঞ্চি x ২ ফুট ৫ ইঞ্চি । খোদার পাথর ভিটার বৌদ্ধ মন্দিরদেখে অনুমান করা চলে যে , এখানে একসময় বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল ।
৫। পরব্রামের প্রাসাদ ও সভাবাটী :
এই প্রাচীন প্রাসাদের আয়তন ২০০ ফুট x ১০০ ফুট । কথিত আছে যে , এটি হচ্ছে মহাস্থানগড়ের সর্বশেষ হিন্দু রাজা পরশুরামেররাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ । খোদার পাথর ভিটা থেকে যে বিস্তৃত রাস্তাটি মথুরা গ্রাম ও বসুবিহার পর্যন্ত প্রসারিত তারই পাশেঅবস্থিত পরশুরামের সভাবাটী । কথিত আছে , এখানেই পরশুরাম তার রাজসভার কাজ পরিচালনা করতেন । পরশুরামছিলেন হিন্দু রাজা । তাই ওই সময়ে মহাস্থানগড়ে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক ছিল না।
৬। শীলাদেবীর ঘাট :
কথিত আছে যে , মহাস্থানগড়ের সর্বশেষ হিন্দু রাজা পরশুরামের শীলাদেবী নামে পরমা সুন্দরী ভগ্নি ছিল । যখন মুসলমানগণরাজা পরশুরামকে পরাজিত ও নিহত করে তখন শীলাদেবী মুসলমানদের হাতে বন্দী হন । তবে তিনি নাকি নিজ মর্যাদা রক্ষার্থেবিজয়ী মুসলমান দরবেশকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে করতোয়া নদীতে আত্মবিসর্জন দেন । যে স্থানে শীলাদেবী নদীতে ঝাপ দিয়েআত্মহত্যা করেন সেটিই শীলাদেবীর ঘাট নামে পরিচিত ।
৭। লক্ষ্মীন্দরের মেধ :
বাংলাদেশের অন্যতম চিত্রাকর্ষক লোক কাহিনীর নায়ক – নায়িকা বেহুলা – লক্ষ্মীন্দরের নামে একটি ধ্বংসস্তূপের এমন নামকরণকরা হয়েছে । মূল মহাস্থানগড় থেকে এক মাইল দক্ষিণ – পশ্চিম প্রায় ৪৩ ফুট উঁচু এক ঢিবির ওপর মেধ মন্দিরটি অবস্থিত ।ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা হয়েছে যে , এটি বৌদ্ধদের একটি কেন্দ্রীয় উপাসনালয় ছিল । ! বর্তমান অবস্থা মহাস্থানগড়েরবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বহুসংখ্যক প্রাচীন নিদর্শন । প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে । মুসলিম যুগের শেষপর্যন্ত বহু নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ খননকার্যের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন । এসব দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , সত্যিই মহাস্থানগড়একটি ইতিহাস – প্রসিদ্ধ স্থান ।
উপসংহার :
সুদূর অতীতের স্মৃতি বুকে ধরে মহাস্থানগড় ইতিহাসের পাতায় ঘুমিয়ে থাকলেও মানুষ তাকে ভোলেনি । আজও বহু পর্যটক , বহুগবেষক এবং বনভোজন পার্টির আনাগোনায় ও ভিড়ে মহাস্থানগড় চঞ্চলতা ও আনন্দ – উল্লাসে মুখরিত । দেশের প্রাচীনঐতিহ্যের গরিমা সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে এসব পুরাকীর্তির যথাযথ তত্ত্বাবধান খুবই প্রয়োজনীয়।