মানবজীবনে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা (বাংলা রচনা)
ভূমিকা :
এ পৃথিবী একটি নিয়মের রাজত্ব । শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা মানবজীনের এক ধরনের কল্যাণমুখী বন্ধন । প্রতিকূল প্রাকৃতিকপরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শৃঙ্খলার নানা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করেই মানুষ অর্জন করেছে প্রাণিজগতে শ্রেষ্ঠত্বের আসন, গড়ে তুলেছে এ বিস্ময়কর সমাজ – সভ্যতা । সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে মানুষকে পালন করতে হয় নানাবিধ সামাজিক দায়িত্বএবং মেনে চলতে হয় বহুবিধ আইন । ব্যক্তিজীবনের সুষ্ঠু বিকাশে অনুসরণ করতে হয় সঠিক আদর্শ । তার প্রতিটি কর্মের জন্যপ্রয়োজন হয় সুষম সমন্বয়ের । এভাবে ব্যক্তিজীবনে গড়ে ওঠে শৃঙ্খলবোধ এবং তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে সুশৃঙ্খল জাতি।
নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা :
জীবনের সর্বস্তরে তথা সামাজিক , পারিবারিক , রাষ্ট্রীয় জীবনে , খেলার মাঠে , কলকারখানায় , অফিসে , দোকানে , ট্রেনে , বাসে, হাসপাতালে , বিমানে প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তী হওয়া অত্যাবশ্যক । নিয়ম – শৃঙ্খলার অভাবে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানওধ্বংস হয়ে যায় । খেলার মাঠে এবং যুদ্ধের ময়দানে নিয়ম পালন না করলে পরাজয় অনিবার্য । সুতরাং নিয়মানুবর্তিতা বাশৃঙ্খলাবোধের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ।
প্রকৃতিতে নিয়মানুবর্তিতা :
প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের সর্বত্র নিয়মের রাজত্ব চলছে । নিয়ম না মানলে প্রাণিজগত হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খল । পাখিরা ভোরবেলা জেগেগান করে , দিনে খাদ্যান্বেষণে ঘুরে বেড়ায় , রাতে বিশ্রাম করে । এদের সবকিছুই নিয়মমাফিক হয়ে থাকে । আবার যারা নিশাচরপ্রাণী তারা রাতকে করে তুলে জীবনবিকাশের মুহূর্ত , দিনে থাকে নিষ্ক্রিয় । মৌমাছি , পিপীলিকা দল বেঁধে তাদের নেতার নির্দেশমেনে চলে । মৌমাছি চমৎকার মৌচাক নির্মাণ করে সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে । গ্রহ , তারা – নিহারিকা নিয়ম মেনে নিজনিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয় । দিবা – রাত্রির সংঘটন , ঋতুচক্র সবকিছুই নিয়মের অধীন ।
সমাজজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :
নিয়ম ছাড়া সামাজিক জীবন চলতে পারে না । বিভিন্ন সামাজিক আচার – অনুষ্ঠান ; যেমন– বিবাহ , পূজা পার্বণ , খাওয়া – পরাসবকিছুই নিয়ম অনুযায়ী হয়ে থাকে । নিয়ম না থাকলে সমাজে শান্তি – শৃঙ্খলা থাকে না । সমাজে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা আছেবলেই আমরা আত্মীয় – স্বজন , বন্ধু – বান্ধব মিলে সুখে – স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারি । মোটকথা , নিয়মানুবর্তিতা ওশৃঙ্খলাবোধ সমাজজীবনকে সুন্দর করে তোলে।
মানবজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব । অন্যান্য প্রাণী থেকে তার পার্থক্য হচ্ছে , সে বুদ্ধিমান ও নিয়মের পূজারী । নিয়মানুবর্তিতা বাশৃঙ্খলাবোধ না থাকলে মানবজীবন হয়ে ওঠে বিষময় । নিয়ম না থাকলে অবস্থা হতো ‘ জোর যার মুলুক তার । নিয়মানুবর্তিতাইমানবজীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলে । যে ব্যক্তি যথানিয়মে নিজ কর্তব্য সম্পাদন করে তার উন্নতি অবধারিত ।
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন সর্বাধিক । নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা ও চর্চার উপযুক্ত সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন। একজন ছাত্রকেনিয়মমাফিক লেখাপড়া করতে হয় , সময়মতো পরীক্ষা দিতে হয় । এভাবে নিয়ম পালনে তাকে অভ্যস্ত হতে হয় । নিয়ম মানাছাড়া ছাত্রজীবনে সার্থকতা লাভ অসম্ভব । খেলার সময় খেলা , পড়ার সময় পড়ার নিয়ম না মানলে ছাত্রজীবনে সার্থকতা আসেনা।
জাতীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা :
যেকোনো জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হচ্ছে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষা করা । উচ্ছল ও ঐক্যহীন জাতি সংহতিরঅভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসন লাভ থেকে বঞ্চিত হয় । দেশে আইনের শাসন রক্ষায় নাগরিকদেরশৃঙ্খলাবোধ জরুরি । পৃথিবীর অনেক দেশ জাতীয় সংহতি তথা নিয়ম – শৃঙ্খলার অভাবে কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি অর্জন করতে ব্যর্থহয়েছে ।
যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা :
শুধু সৃষ্টিশীলতা , আবিষ্কার বা অভিযানের ক্ষেত্রে নয় , যুদ্ধক্ষেত্রেও নিয়মের প্রয়োজন রয়েছে । সেনাবাহিনীতে যে বিষয়টির ওপরবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলা । এই নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলার ফলেই যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভকরা সম্ভব । আর শৃঙ্খলা ভেঙে গেলে পরাজয়ের গ্লানি অনিবার্য । পলাশীর যুদ্ধে যে যুদ্ধে বাংলার ভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয় ।ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে এই শৃঙ্খলা ছিল বলেই তারা জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল । পক্ষান্তরে , নাবাব সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাভেঙে যায় বলেই নবাব সিরাজ – উদ – দৌলাকে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল ।
নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গের পরিণতি :
নিয়ম ভঙ্গের পরিণতি সর্বদাই অশুভ । এ শুধু প্রকৃতিতে নয় , মানবজীবনেও সত্য । ব্যক্তি , সমাজ কিংবা জাতীয় জীবনেরযেকোনো ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী । মহানবি ( স ) –এর নির্দেশ অমান্য করে মুসলিম বাহিনী ওহুদেরযুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল । নিয়মানুবর্তিতার অভাবে প্রতিভাবান মানুষের জীবনও ব্যর্থ হয়েযায় । মোটকথা , নিয়মানুবর্তিতার অভাব শুধু জীবনের গ্লানিই বাড়ায় ।
উপসংহার :
নিয়মানুবর্তিতা পাশ্চাত্য জাতিসমূহের একটি মহৎ চারিত্রিক গুণ । সেজন্য সবদিক দিয়ে তারা সমৃদ্ধ । শক্তিতে , ধনে , মানে , জ্ঞানে তারা শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী । আমাদের জাতীয় চরিত্র নিয়মানুবর্তিতার অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে । তাই জাতীয় উন্নতিরআকাঙ্ক্ষা থাকলে আমাদের প্রত্যেকেরই নিয়মানুবর্তী হওয়ার শিক্ষা লাভূ করতে হবে । ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজকর্মকরার অভ্যাস গড়ে তোলা একান্ত দরকার । দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মে অবহেলা না করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবোধ আনয়ন করাঅপরিহার্য।