মানব কল্যাণে বিজ্ঞান রচনা/দৈনন্দিন কাজে বিজ্ঞান রচনা (Science in human welfare)
ভূমিকা:
ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে “necessity is the mother of invention”অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদেই আবিষ্কার এর জন্ম।বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের জয়যাত্রা এক যুগান্তকারী যুগ। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আজ ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ।বিজ্ঞানমানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় গতি ।দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে এমন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করে রেখেছে যে ,সেখানে বিজ্ঞানছাড়া স্বাভাবিক জীবন কল্পনা করা যায় না। এটি আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মানব সভ্যতায় বিজ্ঞান:
প্রাচীনকালে গুহা বাসী মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতের অসহায় ক্রীড়নক ।আদিম মানুষ যখন প্রথম পাথর দিয়ে হাতে তৈরি করেপাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালায় তখন থেকেই শুরু হয় বিজ্ঞানের আবিষ্কার। তার পর যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেমানুষ সমগ্র পৃথিবীর বিস্তার করেছে কর্তৃত্ব।
মানব জীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান:
মানব জীবনের প্রতিটি শাখা আজ বিজ্ঞানের বহুবিধ অবদানের সমৃদ্ধ। যাতায়াত,কৃষি, শিক্ষা,চিকিৎসাসহ মানব জীবনের সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানের রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা।বিজ্ঞানকে এখন বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করাহচ্ছে।
কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
বিজ্ঞানের বদৌলতে কৃষিতে মানুষ এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । মানুষ আবিষ্কার করেছে ট্রাক্টর সহ নানা রকম কৃষি সরঞ্জাম।পাম্প ব্যবহার করে ভূ–অভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন করে সেচ কাজ সম্পন্ন করছে।কীটনাশক এর সাহায্যে পোকামাকড় ওপঙ্গপালের হাত থেকে ফসল রক্ষা করছে। তা ছাড়াও মরুভূমির মতো ঊষর জায়গায় ও কৃষি কাজ করা সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্রবিজ্ঞানের অবদানের কারণে।
যাতায়াতেরক্ষেত্রে বিজ্ঞান :
বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় গতি ।আগে যেখানে একস্থান হতে অন্য স্থানে যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হতো তা বর্তমানেআর নেই। বিজ্ঞানের অবদানে ডাঙ্গায় ছুটছে বাস–ট্রেন ,জলে ঢেউয়ের জুটি জাপটে ধরে জাহাজ ছুটে চলেছে, আকাশে তোলপাড়করে উড়ে চলেছে দ্রুতগামী উড়োজাহাজ, মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে রকেট ।আর এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানেরআবিষ্কারের ফলে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে আজ মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মানুষের সাথে টেলিফোনে কথা বলতে পারচে।টেলিভিশন, রেডিও, ইমেইল মুঠোফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের খবর যেকোনো মুহূর্তে জানতে পারছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমেলেনদেন করা হচ্ছে কম্পিউটারের তথ্যাবলী ।এককথায় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাফল্যগুলো কম বিস্ময়কর নয়। চোখের কর্নিয়া থেকে শুরু করে যকৃতের মত অঙ্গ–প্রত্যঙ্গপ্রতিস্থাপনের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সাফল্য অভাবনীয়। মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ ফুসফুস, শিরা, ধমনী ইত্যাদির অবস্থাযন্ত্রের সাহায্যে অবলোকন করে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়াও বহুমূত্র রোগের অন্ধত্ব প্রতিরোধ এ ব্যবহৃতহচ্ছে লেজার রশ্মি। কম্পিউটার প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞান কে নিয়ে এসেছে সর্বাধুনিক পর্যায়ে ।এর মাধ্যমে ছবি তুলে রোগ নির্ণয়করা সম্ভব হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অতুলনীয় ।শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান প্রায় সবই বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ।বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষাব্যবস্থাকে করেছে আরো আধুনিক ও উন্নত। এখন বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে রেডিও–টেলিভিশন শিক্ষারমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কম্পিউটার বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করেছে এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতি।
আবহাওয়া বিজ্ঞান:
আবহাওয়ার খবরাখবর বের করতে গিয়ে বিজ্ঞান তার প্রচন্ড ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে ।এখন সাত/আট দিনআগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।তাছাড়াও কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে খনিজ সম্পদ, তেল ও গ্যাসের উৎস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে ।শুধু তাই নয় আরও জানা যাচ্ছেপঙ্গপালের আক্রমণের আশঙ্কা সম্পর্কে।
জ্ঞান বিস্তারে বিজ্ঞান:
ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন বিখ্যাত লাইব্রেরির ,বিখ্যাত শহর ,বন্দর ,বাণিজ্য ইত্যাদি সম্পর্কে মুহূর্তের মধ্যে উপাত্ত সংগ্রহ করাযাচ্ছে। আর এভাবেই জ্ঞান বিস্তারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এক মহান ভূমিকা পালন করছে ।
নাগরিক সভ্যতা বিজ্ঞান:
মানুষের জীবন আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে আলোকময় ও সুসজ্জিত ।দেহ–সজ্জাতে বিজ্ঞান এনেছেপরিবর্তন ।খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞান স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছে । স্কিন ও প্লাস্টিক সার্জারির মধ্যে কাটা পোড়া ক্ষত দূর করা সম্ভবহচ্ছে ।কৃত্রিম অঙ্গ শুধু সৌন্দর্য নয় এগুলো দিয়ে কাজও চলছে। আর এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের কারণে।
তথ্য প্রবাহে বিজ্ঞান:
বর্তমান যুগ তথ্য বিপ্লবের যুগ। কম্পিউটার, টেলিফোন ,ইমেইল ,ইন্টারনেট প্রভৃতি সারা পৃথিবীতে একটি অভিন্ন যোগাযোগনেটওয়ার্ক আবদ্ধ করেছে ।স্যাটেলাইট যোগাযোগের কল্যানে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। শুধুতাই নয় মোবাইল ফোন ছাড়া ও এখন চালু হতে যাচ্ছে টেলিপ্যাথি যার মাধ্যমে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির মনোভঙ্গিপর্যন্ত অনুভব করা যাবে।
বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে ।বাড়িঘর করেছে আলোকিত। আবিষ্কার করেছে নানাবিধ উপকরণ ।বিদ্যুতের আবিষ্কার এর ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে মোবাইল, কম্পিউটার,ল্যাপটপ সহ আরো নানান ধরনের পদ্ধতি যন্ত্রপাতি ।যেগুলো ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল।
বিনোদন সঙ্গী বিজ্ঞান:
মানুষের মানসিক আনন্দের জন্য বিজ্ঞান দিয়েছে নানা রকম উপকরণ। বিজ্ঞান আজ মানুষের বিনোদন সঙ্গী।বেতার, টেলিভিশন, চলচিত্র ও ক্যামেরাসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিনোদন জগতে এনেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন।মুহূর্তের মধ্যেই জনপ্রিয়গান বা সিনেমা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা:
আজ বিজ্ঞানের জয়ধ্বনি ঘোষিত হলেও পৃথিবীতে তার সূচনা হয়েছিল অত্যন্ত দীনভাবে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ আজ খনিরঅন্ধকারে আলো জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে ।বিজ্ঞানের শক্তিবলে নদীর স্রোতকে বশীভূত করে উশর মরুপ্রান্তকে করেছে জলসিক্ত, দূর করে দিয়েছে পৃথিবীর অনুর্বরতা অভিশাপ বিজ্ঞানের সাফল্যে জীবন আজ হয়ে উঠেছে আনন্দময়।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান:
বিজ্ঞান মানুষকে এনে দিয়েছে আরাম–আয়েশ,আনন্দ–বিনোদন, রান্নায় চুলের ভূগর্ভের গ্যাস,প্রেসার কুকারে রান্না,অফিস গমনেযান্ত্রিক যান,গরম থেকে রক্ষা পেতে ফ্যান, এয়ার কুলার এগুলো ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল ।মোটকথা আমাদেরদৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
শিল্প কারখানায় আগে সব কাজই হাতে করা হতো।বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ সেসব কাজ যন্ত্র দ্বারা করানো হচ্ছে। ফলে খরচ কমপড়ছে। সময় কম বের হচ্ছে এবং অধিক উৎপাদন হচ্ছে।
বিজ্ঞানের উপকারিতা:
বিজ্ঞান সৃষ্টির পর থেকেই মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তন ঘটেছে।বিজ্ঞান মানুষের শ্রম কে লাভ করেছে। এনে দিয়েছে আরাম–আয়েশ,সুখ, দুরকেকরেছে আপন।জীবনকে করেছে আরামদায়ক। তাই বলা হয়েছে বিজ্ঞান মানব সভ্যতার উন্নতির প্রধানহাতিয়ার।
বিজ্ঞানের অপকারিতা:
বিজ্ঞান শুধু মানুষের উপকারী করেনি।স্বয়ংক্রিয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্র মানুষের কাজ সম্পাদন করতে শুরু করার পরপরই অসংখ্যমানুষ বেকার পরিণত হয়েছে।মোটর চালিত গাড়ি ও যন্ত্রপাতি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ অনেকসময় পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি করছে।পরিবেশ দূষণের ফলে পৃথিবীর উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে ও মেরুদয়ের বরফগলা শুরু করেছে।মানুষ বিজ্ঞানের অপব্যবহার দেখে মেতে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।তখন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে হিরোশিমানাগাসাকির মতো শহর ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল।অতএব বিজ্ঞান এর খারাপ দিক ও কম নয়।
উপসংহার:
বিজ্ঞানের অবদান মানুষ কখনো অস্বীকার করতে পারবে না।সচেতন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাজ হল বিজ্ঞান এর সার্থক ওইতিবাচক প্রয়োগ ঘটানো।বিজ্ঞানের আলোকে মানব জীবনকে আলোকিত করা। বিজ্ঞানের অপব্যবহার রোধে সচেতন হয়েবিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারলে তা মানব জীবনে আরও ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।