মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলা রচনা
ভূমিকা :
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে যে শোষণ ও অত্যাচারের শুরু হয়েছিলতার অবসান ঘটে এই যুদ্ধের মাধ্যমে । সমগ্র জাতি দেশের মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের চেতনায় নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলএই যুদ্ধে । ফলে একসাগর রক্তের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের । মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্ব , আমাদের অহংকার । মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালি জাতির কাছে স্বর্ণময় এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরইতিহাস ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তা জানানোর জন্য সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধজাদুঘর।
জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা :
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকাস্থ সেগুনবাগিচার একটি দোতলা ভবনে প্রতিষ্ঠা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর । বাংলাদেশের গৌরবময়মুক্তিযুদ্ধ – সংক্রান্ত তথ্য , প্রমাণ , বস্তুগত নিদর্শন , রেকর্ডপত্র ও স্মারকচিহ্নসমূহ সংগ্রহ , সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের সুব্যবস্থা করাহয়েছে এখানে । নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে ঐতিহাসিক ঘটনাধারা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে দেশের কয়েকজন বরেণ্যব্যক্তি স্ব – উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন । প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আলী জাকের, সারা যাকের , আসাদুজ্জামান নূর , জিয়াউদ্দিন , তারেক আলী , ডা . সারওয়ার আলী , রবিউল হুসাইন , আকু চৌধুরী ওমফিদুল হক । এঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন স্মারক , তথ্য – প্রমাণ ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিচালিত হয় একটি ট্রাস্টি বোর্ডের সুদক্ষ তত্ত্বাবধানে ।
জাদুঘরের অবকাঠামো :
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রবেশপথের মুখেই রয়েছে ‘ শিখা চির অম্লান । তারকা – আকৃতির একটি বেদির ওপর জ্বলছে অনির্বাণশিখা ।সাক্ষী বাংলার রক্তভেজা মাটি সাক্ষী আকাশের চন্দ্রতারা । ভুলি নাই শহীদদের কোনো স্মৃতি ভুলব না কিছুই আমরা ।দোতলা বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মধ্যে রয়েছে ছয়টি গ্যালারি।নিচ তলায় তিনটি ও ‘ দোতলায় তিনটি । প্রথম গ্যালারিরনিদর্শনগুলো দুটি পর্বে বিন্যস্ত । প্রথম পর্বে প্রদর্শিত হয়েছে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি । যেমন– সিলেট অঞ্চলেপ্রাপ্ত ফসিল , পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারের মডেল , ভুটান থেকে পাওয়া শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের মূর্তি , বাগেরহাটের বিখ্যাতষাটগম্বুজ মসজিদের মডেলসহ বিভিন্ন মসজিদের টালির নিদর্শন এবং মন্দিরের পোড়ামাটির কারুকাজ।এসবের পাশাপাশিএখানে রয়েছে।নানা সময়ের মুদ্রা , তালপাতার লিপি ও তুলট কাগজে লেখা মনসামঙ্গল কাব্যের অংশবিশেষ। দ্বিতীয় পর্বেপ্রদর্শিত হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগ্রামের চিত্র।
যেমন– নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেখানে পরাজিত হয়েছিলেন সেই পলাশীর আম্রকাননের মডেল ; সিরাজউদ্দৌলা , টিপু সুলতান , তিতুমীর , রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিকৃতি ; ক্ষুদিরাম , প্রফুল্ল চাকী , যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি , মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকতআলীর ফটোগ্রাফ । আরও আছে সিপাহি বিদ্রোহের স্থিরচিত্র , চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের শহিদদের চিত্র , কাজী নজরুলইসলাম সম্পাদিত ‘ ধূমকেতু ‘ পত্রিকার কপি এবং ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের— যাকে আমরা ‘ পঞ্চাশের মন্বন্তর ‘ বলি , তার করুণ দৃশ্যের ছবি । দ্বিতীয় গ্যালারিতে তুলে ধরা হয়েছে পাকিস্তান আমলের ইতিহাস । ১৯৫২‘র ভাষা আন্দোলন , ‘৫৪ –রসাধারণ নির্বাচন , ‘৫৮ র সামরিক শাসন , ‘৬২ র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন , ‘৬৬ র ছয় দফার আন্দোলন , আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা , ‘৬৯ –এর গণ অভূত্থান , ‘৭০ –এর ভয়াবহ জলোচ্ছাস ও নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল , ছবি ওস্মারক। তৃতীয় গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন , ২৫ মার্চ রাতের সংঘটিত গণহত্যা , স্বাধীনতারঘোষণা , প্রাথমিক প্রতিরোধ , প্রবাসী সরকার সংক্রান্ত ছবি ও শরণার্থীদের জীবনচিত্র । দোতলার তিনটি গ্যালারি সাজানোহয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য , প্রমাণ ও চিত্র দিয়ে । প্রথমটিতে ( চতুর্থ গ্যালারি ) রয়েছে , পাকবাহিনীর নিষ্ঠুরতার বিভিন্ন ছবি , শহিদ মুক্তিযোদ্ধা , প্রাথমিক প্রতিরোধ , প্রবাসী সরকার এবং সেক্টর কমান্ডারদের নানা তৎপরতার থ্য ও ছবি।পরেরটিতে আছেপ্রতিরোধের লড়াই , গেরিলাযুদ্ধ , নৌ – কমান্ডো , বিমানবাহিনী , স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র , মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিকসমর্থন , রাজাকার – দালালদের ভূমিকা এবং সশস্ত্র যুদ্ধের ছবি , স্মারক ও বিবরণ । সবশেষে রয়েছে গণহত্যা , “ হিদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ , শহিদ বুদ্ধিজীবী , চূড়ান্ত লড়াই এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্মারক , বিবরণ ও ছবি ।
প্রতিটি গ্যালারিতে আছেন একজন চৌকস গাইড । তিনি দর্শনার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে তাদের কৌতূহল নিবৃতকরেন।মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর চত্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানারকম বই , পপাস্টার , ক্যাসেট , সিডি , স্মারকসামগ্রী বিক্রির জন্যএকটি পুস্তকবিপণী , একটি খাবারের দোকান ও একটি উন্মুক্ত মঞ্চ এবং সামনের অংশে আছে ১০০ আসন বিশিষ্ট একটিচমৎকার । অডিটোরিয়াম ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রম :
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস – ঐতিহ্য সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাকরে থাকে । জাদুঘর পরিদর্শনের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ছাত্র – ছাত্রীদের জন্য পরিবহন সুবিধাসহ এখানে নানা সুযোগ – সুবিধাপ্রদান করা হয়ে থাকে । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রদর্শনীর জন্য একটি গাড়িকে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধজাদুঘরের অডিটোরিয়ামে ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমন্ত্রিত দর্শকদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয় । উন্মুক্তমঞ্চে আয়োজন করা হয়ে থাকে নানা অনুষ্ঠানের । মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংগৃহীত স্মারক সংখ্যা প্রায় এগার হাজার । মুক্তিযুদ্ধজাদুঘর বিশ্বের আরও আটটি দেশের সমভাবাপন্ন জাদুঘরের সঙ্গে মিলে ‘ ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টরিক মিউজিয়ামঅব কনসান্স ‘ গঠন করেছে।
উপসংহার :
যেকোনো জাদুঘর দেশের ইতিহাস – ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জনসমক্ষে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে অতীত এবং বর্তমানেরমধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরগুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি – স্মারক – দলিলপত্রের একমাত্র সংগ্রহশালা।আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবেজানতে পারে , ভুলে । যায় , সে লক্ষ্যেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে।