লাইব্রেরি / গ্রন্থাগারের প্ৰয়োজনীয়তা বাংলা রচনা
ভূমিকা :
পুস্তকের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলা হয় । সর্বপ্রকার জ্ঞানকে একত্রিত করে স্থায়িত্ব দানের অভিপ্রায় থেকেগ্রন্থাগারের সৃষ্টি । এক ব্যক্তির পক্ষে সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া অসম্ভব । বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে ।আবার যে ব্যক্তি যে – বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে , তার সবটুকু কোনো মস্তিষ্কে ধারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না । তাইপ্রয়োজন এমন কোনো উপায় উদ্ভাবনের , যার বদৌলতে প্রয়োজন অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ের একটা মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা যায়। ফলে গ্রন্থাগারের বা লাইব্রেরির সৃষ্টি ।
প্রকারভেদ :
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার চার প্রকার । যথা– ব্যক্তিগত , পারিবারিক , সাধারণ ও ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার । ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার : ব্যক্তিগতগ্রন্থাগার ব্যক্তিমনের খেয়ালখুশি মতো গড়ে ওঠে– তা হয়ে থাকে ব্যাক্তির মনের প্রতিবিম্ব । ব্যক্তি যে – ধরনের রচনা ভালোবাসেতার প্রাচুর্য আর যে ধরনের রচনা পছন্দ করে না তার অনুপস্থিতি হয়ে থাকে ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য । এ এখানে ব্যক্তিস্বেচ্ছাচারী সম্রাট , খেয়ালখুশি মতো গড়ে তোলে তার কল্পনার তাজমহল । কাব্যপ্রেমিক হলে কাব্যগ্রন্থ দিয়ে , কথা সাহিত্যপ্রেমিকহলে কথাসাহিত্য দিয়ে , ইতিহাসপ্রিয় হলে ঐতিহাসিক গ্রন্থ দিয়ে সে সাজিয়ে তোলে তার টেবিল , আলমারির শেল্ফ সবকিছু ।কারো বাধা দেবার অধিকার এখানে নেই , আপত্তি করার দাবি নেই , উপদেশ দেবার প্রয়োজনীয়তা নেই । এখানে সে স্বাধীন , স্বতন্ত্র ।
পারিবারিক গ্রন্থাগার :
ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার যেমন ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিবিম্ব , পারিবারিক গ্রন্থাগার তেমনি পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের সমষ্টিগত ইচ্ছারপ্রতিচ্ছায়া । ওখানে যেমন একের রুচির ওপর বহুর অত্যাচার অশোভন , এখানেও তেমনি একের রুচির ওপর একের জবরদস্তিঅন্যায় । দশ জনের রুচির দিকে নজর রেখেই পারিবারিক গ্রন্থাগার সাজাতে হয় ।
সাধারণ গ্রন্থাগার :
সাধারণ গ্রন্থাগার আধুনিক জিনিস । কারণ যে জ্ঞানার্জন স্পৃহা থেকে পাঠাগারের জন্ম , ব্যাপকভাবে তার জাগরণ অপেক্ষাকৃতহালের ব্যাপার বলেই মনে হয় । কিন্তু সাধারণের পুস্তক কেনা যে কি রকম দুঃসাধ্য ব্যাপার , তা ধারণা করা সহজ । পুস্তকেরব্যাপারেও সমবায়নীতির প্রবর্তন আবশ্যক । অর্থাৎ এক্ষেত্রেও দশে মিলে কাজ না করলে সার্থকতা লাভ করা অসম্ভব । এব্যাপারে দশের মিলিত ফলস্বরূপ যা পাওয়া যায় তাকেই সাধারণ লাইব্রেরি বলা হয় । অবশ্য সাধারণ লাইব্রেরি ব্যক্তির দানওহতে পারে । তবে ব্যক্তিগত প্রভাবের চাইতে সাধারণের প্রভাবই সেখানে বলবৎ হতে বাধ্য ।
ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার :
ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার সাম্প্রতিক কালের সৃষ্টি । অনেকে সুনির্দিষ্ট গ্রন্থাগারে গিয়ে পড়াশুনার সুযোগ পান না । কোনো নির্দিষ্টগ্রন্থাগারের দূরত্বের জন্যও অনেকে যেতে অক্ষম । তখন ওই গ্রন্থাগারের বা প্রকাশনার বই লাইব্রেরির মতো সাজানো বড় গাড়িতেকরে কাছাকাছি জায়গায় পৌছে যায় । এই ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি থেকে নির্দিষ্ট পাঠকরা তখন বই ধার নিতে পারেন । এখানেএকজন লাইব্রেরিয়ান আসেন । তিনি বই ধার দেন । ঢাকার ‘ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ‘ বাংলাদেশে ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার চালু করেছে । এগ্রন্থাগার শিশু – কিশোরদের খুব প্রিয় । গ্রন্থাগার মানসিক সৌন্দর্যের পরিচায়ক । ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গ্রন্থাগার ব্যক্তি বাপরিবারের মর্জিমাফিক গড়ে ওঠে বলে সাধারণের হুকুম চালাবার মতো সেখানে কিছু নেই । গ্রন্থাগারসম্পন্ন ব্যক্তির চাল – চলনেএমন একটা শ্ৰী ফুটে উঠতে বাধ্য , যা অন্যত্র প্রত্যক্ষ করা দুষ্কর । সত্যিকার সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের অধিকারী হতে হলে গ্রন্থাগারেরসঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করা অবশ্য প্রয়োজনীয় । তাছাড়া গ্রন্থাগার বা শ্রেণিবদ্ধ পুস্তক সংগ্রহ গৃহসজ্জার কাজেও লাগে।এই ধরনেরগৃহসজ্জায় লাভ এই যে , বাইরের পরিপাটের সঙ্গে তা মানসিক সৌন্দর্যের পরিচয় দেয়।গ্রন্থাগার সৃজনে ধনী ব্যক্তির পুস্তক কেনারনেশা সৃষ্টি করলে দেশের পক্ষে লাভ হবে এই যে , অনবরত পুস্ত কগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে তাদের চামড়ার তলে যে একটি মনসুপ্ত রয়েছে , সে সম্বন্ধে তাঁরা সচেতন হয়ে উঠবেন । লাইব্রেরি সৃজনের দরুণ তারা নিজেরা ততটা লাভবান না হলেও পুত্র – কন্যাদের যথেষ্ট উপকৃত হবার সম্ভাবনা । হয়তো এই লাইব্রেরি থাকার দরুণই পরিণত বয়সে তারা সুসাহিত্যিক বা সাহিত্যিক হয়েউঠবেন । এ আশা শুধু ভিত্তিহীন কল্পনা নয় , বড় বড় সাহিত্যিক বা কবিদের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায় , বাল্যকালেতারা পিতা অথবা পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে সাহিত্য সাধনার প্রেরণা লাভ করেছেন ।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা :
আমাদের স্বাধীন দেশে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।মানুষ ক্রমে উপলব্ধি করছে , খাদ্যই সব নয় , মনেরও খাদ্য দরকার । গ্রন্থাগার পারে ক্লান্ত , বুভুক্ষু মানুষের মনকে প্রফুল্ল করতে , তাকে পছন্দমাফিক জিনিসের সন্ধান দিয়ে তার মনে খোরাক জোগাতে । এদিকে দেহের খাদ্যের ক্ষেত্র যেমন জনে জনে পার্থক্য ওরুচিভেদ , মনের খাদ্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ । কেউ কবিতার বই পড়তে ভালোবাসেন , আবার কেউবা গল্প – উপন্যাস , কেউ নাটকপেলে অন্য কিছু চান না , কেউ কেউ আবার ভ্রমণ কাহিনী ভালোবাসেন । এছাড়া কারো প্রিয় দর্শন , কারো বা ইতিহাস , কেউখোঁজেন লোকসাহিত্য – বিষয়ক বই , আবার কেউ কেউ পদার্থ , রসায়ন বা প্রাণিবিজ্ঞান । কেউ কেউ দেশের ইতিহাস , অর্থনীতি , সমাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে নতুন তথ্য খুঁজে বের করবেন বলে অনুসন্ধিৎসু । তাঁরা দলিল – দস্তাবেজ , বিবর্ণ প্রাচীন পুঁথি এবংঅতীত যুগের পত্রিকা থেকে বের করেন নিজের চাহিদার খোরাক।তাই গ্রন্থাগারের নানাবিধ প্রয়োজনীয়তায় সমাজের মানুষনানাভাবে উপকৃত হয়ে থাকে । তবে সুষ্ঠুভাবে গ্রন্থ সংগ্রহ অতি দুরূহ কাজ । প্রতিদিন দেশ – বিদেশে হাজার হাজার নতুন গ্রন্থপ্রকাশিত হচ্ছে । গ্রন্থাগারের সঙ্গতি ও প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে উৎকৃষ্ট গ্রন্থকেই সংগ্রহের জন্য নির্বাচন করা শ্রেয় । আবারশুধুমাত্র সংগ্রহ করলেই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব শেষ হয় না , সংগৃহীত গ্রন্থগুলো যাতে সযত্নে থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয় ।নানাবিধ পোকার উদ্ৰবে , প্রাকৃতিক বাধা – বিপত্তি এবং অসৎ পাঠক ও গ্রন্থাগার কর্মীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অনেক সময় বহুউৎকৃষ্ট এই নষ্ট হয় । ওই সব সংগৃহীত গ্রন্থগুলো দেশ ও জাতির অমূল্য সম্পদ , গ্রন্থাগারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেরই এ কথা মনেরাখা উচিত।
বাংলাদেশে গ্রন্থাগার :
বাংলাদেশে ১৯৫৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি । এই লাইব্রেরির , সহযোগিতায় শতাধিক সরকারি ওবেসরকারি গ্রন্থাগার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে । বিদেশি দূতাবাসের আনুকূল্যে আমাদের দেশে যেসব লাইব্রেরিপরিচালিত হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এছাড়া আমাদের দেশে সরকারিগ্রন্থাগারের সংখ্যা ৬৮ টি , বেসরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা ৮৮৩ টি , গণ – উন্নয়ন পাঠাগারের পরিচালনায় রয়েছে ২৭ টিগ্রন্থাগার।
উপসংহার:
বর্তমানে জ্ঞান – বিজ্ঞানে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে । পৃথিবীর বিভিন্ন অগ্রসর ও উন্নত দেশেগড়ে উঠেছে নানা ধরনের গ্রন্থাগার । আমাদের বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয় । স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এ দেশের গ্রন্থাগারের সংখ্যাঅনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে গ্রন্থাগার সম্পর্কে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে । আমাদের দেশের পাবলিকলাইব্রেরি , বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র , বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার জনগণের গ্রন্থপাঠের প্রয়োজন মেটাচ্ছে।