শামুক by হাসান আজিজুল হক | শামুক by Hasan azizul huq
বইয়ের নাম |
শামুক |
লেখক |
হাসান আজিজুল হক |
Publisher |
কথাপ্রকাশ |
ভাষা |
বাংলা |
দেশ |
বাংলাদেশ |
পেজ |
৯৫ |
“শামুক ’ বইটি নিয়ে লেখকের কিছু কথা
শামুক আমার ১৮ বছর বয়সে লেখা । এ কথাটা বলার প্রয়োজন এই জন্যে যে , ১৯৬২ সালের আগে এটা আদৌ প্রকাশিত হয়নি। এর মাঝখানে ঘটেও গিয়েছে অনেক কিছু । সেটা একটু পরিষ্কার করা দরকার । প্রথমত , ১৯৫৭ সালে যখন উপন্যাসটি লিখি , তখন দৌলতপুর বিএল কলেজের ছাত্র আমি । সম্মান শ্রেণিতে পড়ি । ঐ সময়ে কলকাতা থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিপুরস্কার প্রতিযোগিতায় উপন্যাস আহ্বান করা হয়েছিল । একটু – আধটু লেখার চেষ্টা তার আগে থেকেই করছি । যৎকিঞ্চিৎ ।সেটা বলবার মতো নয় । তবুও তো করছি ।
এই প্রতিযোগিতার ঘোষণাটির কথা মাথায় রেখেই আমি উপন্যাসটি লিখি । এই সময় আমার বাড়ির পরিবেশটা অন্য রকমছিল । থাকতাম আমার ভগ্নিপতির বাড়ি । দৌলতপুর কলেজে খেলার যে বিশাল মাঠ আছে সেই মাঠটার দক্ষিণ – পুব কোণেলাল রঙের একটি বাড়ি ছিল । এইখানে আমার ভগ্নিপতি কিছুকালের জন্য অনুপস্থিত ছিলেন , আমার বোনও তার মেয়েকেনিয়ে বর্ধমানে আমাদের বাড়িতে ছিলেন । ফলে বাড়িটি ফাঁকা ছিল । এই বাড়িতে তুমুল রাজনীতির একটি আড্ডাখানা গড়েতুলেছিলাম । সেই সময় আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম । আজকের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তার কোথাও কোনো মিল নেই ।
ছাত্র রাজনীতির একটি আলাদা স্বাতন্ত্র ছিল । সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন করছি । এই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীছিলেন সোহরাওয়ার্দী । তিনি থাকতেন রাওয়ালপিন্ডি বা করাচিতে । সিয়াটো সেন্টো এইসব চুক্তির সঙ্গে তিনি যুক্ত থাকতেচাইতেন । তার মানে আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা দল হয়েছিল সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে । পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ইউনিয়নবরাবরই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল । সেই ছাত্র আন্দোলন এমন একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে , তখন কলেজপ্রশাসন তাকে দমনের জন্য নানা কৌশল নিয়েছিল ।
তারা কী করেছিল জানি না , আমরা হঠাৎ দেখি যে , আর্মির একটি রেজিমেন্ট দৌলতপুর কলেজের ভেতরে ঢুকছে না কিন্তুচারপাশ ঘিরে ফেলেছে । এতে আমরা খুবই বিরক্ত হলাম এবং রাগও হলো। আর্মি দৌলতপুর কলেজের ছাত্রদের উপরেনানারকমভাবে অত্যাচার শুরু করেছিল । প্রহার , ধরপাকড় , আটকে রাখা ইত্যাদি অনেক রকম নিগ্রহ চালিয়েছে । এই নির্যাতনআমার উপরেও নেমে এসেছিল । উপন্যাসটি যখন লিখছি তখনই ঘটনাটি ঘটেছিল । উপন্যাসটির তখন সিকিভাগ লেখাহয়েছে । আমার এখনো মনে আছে , ঐদিন সারাটা রাত গায়ে জ্বর ছিল , শরীরে অসহ্য ব্যথা , সকালে উঠে দেখি ফুলে ঢোল হয়েডাবল হয়ে গেছি । এই ।
সময়টাতেই উপন্যাসটা লিখছি । এই হলো উপন্যাসটি লেখার পটভূমি । বাস্তব বাদ দিয়ে আমি কোনোকিছু ভেবে উঠতে পারিনা । লেখক হিশেবে হয়তো এটা আমার দুর্বলতা যে , কিছুই উদ্ভাবন করতে পারি না । থার্টিজের কথা বলছি । তখনব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছে । আমি এক কেরানির চরিত্র বেছে । নিয়েছিলাম । জীবনের সীমাবদ্ধতাটা , সংকীর্ণতাটা ধরারজন্য । জীবন কত বড়ো, অথচ সেই জীবন কাটাতে হয় স্থবির শামুকের মতো। এটাকে আমি উপন্যাসের প্রধান বিষয় করেছিলামবলেই লিখেছিলাম ‘ তেলাপোকা পাখি নয় । এটা লেখার পরেই মনে হয়েছে যে , বাঃ ! বেশ হয়েছে তো ।
লেখাটা তখন এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলাম । এই উপন্যাস আগাগোড়া একটা হিন্দু চরিত্র নিয়ে লেখা ছিল । কাজেই , বিশেষভাবে মুসলমানদের শিক্ষার অভাব , চাকরির অভাব , এখানটায় পুরো মনোনিবেশ করা হয়েছে উপন্যাসে , এটা ঠিক নয় ।অন্তত আমার মাথায় তা ছিল না । আমি লিখতে শুরু করেছি হিন্দু চরিত্র দিয়ে । হিন্দু আর মুসলিম কেরানি একই ছিল , পার্থক্যছিল না । আমি উপন্যাসটি লিখি এবং মানিক স্মৃতি উপন্যাস প্রতিযোগিতায় জমা দিই ।
ওরা প্রথমে ৩০০ বইয়ের মধ্যে ১০০ বই বাছাই করে , তারপর ১০০ বইয়ের মধ্যে ২৮ টা বই বাছাই করে , তারপরে ২৮ টা বইয়েরমধ্যে বেছে নেয় ৭ টা বই । শামুক ’ এই সাতটি বইয়ের মধ্যেও ছিল । এই টুকু বলতেই আমার বন্ধুরা খুব শ্লাঘা অনুভব করত ।জানিস , ওর উপন্যাসটা পুরস্কার পেলেও পেতে পারে । পুরস্কার ঘোষিত হলে। পুরস্কার পেলেন মতি নন্দী , অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ওপূর্ণেন্দু পত্রী । মতি নন্দীর উপন্যাসের নাম ছিল ‘ নক্ষত্রের রাত , অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাম ছিল সমুদ্র মানুষ আরপূর্ণেন্দু পত্রীর উপন্যাসের নাম ছিল তিন নম্বর ছাগল ছানার গল্প ।
আমি এই উপন্যাসের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম । আমার জীবনে নানা ঘটনা ঘটতে শুরু হলো। আমি রাজশাহীতে চলেএলাম । ঐ ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে খুলনা ছাড়তে বাধ্য হলাম । লেখাটা পড়েই ছিল । এই সময় ‘ পূর্বমেঘ ’ পত্রিকায়লিখতে শুরু করি । পূর্বমেঘ ’ – এ আমি নিয়মিত লিখছি । একবার দেখছি আমার কাছে আর কোনো লেখা নেই । শ্রদ্ধেয়সম্পাদকদ্বয় মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লেখার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন ।
তখন আমি উপন্যাসটি নিয়ে আবার বসি । হিন্দু চরিত্রকে মুসলমান চরিত্রে পরিবর্তন করি । তখন মনে হয়েছিল যে , তা করাযেতেই পারে ।আর একটি কথা বলব , এটি সম্পূর্ণ উপন্যাসটি নয় । অর্ধাংশ মাত্র । বাকি অর্ধেক অংশে ছিল কেরানি যেজীবনটাতে ঢুকতে বাধ্য হলো, সে জীবনটাকে সে কীভাবে কাটালো? সেই অংশটি কোথায় যে আছে , তা আর খোঁজ করা হয়নি ।পরিষ্কার বোঝা যায় , আমি উপন্যাসটি প্রকাশ করতে চাইনি । ১৯৫৭ সালের লেখা ১৯৬২ সালে কেন পত্রিকায় বের হচ্ছেভাবলেই আমার কথাটা বোঝা যাবে । তারপরে আমি উপন্যাসটির কথা আবার ভুলে গেলাম । ওটাকে বই আকারে প্রকাশেকোনো আগ্রহবোধ করিনি ।
তবে এটা আমি স্বীকার করি , এখনো বলি , আগেও বলেছি , যা কিছু আমি লিখেছি , সব তো আমারই লেখা । এটা যখন খুঁজেবের করলেন চন্দন আনোয়ার , তখন আমি অবাকই হলাম । চন্দন আনোয়ার আমার উপরে রিসার্চ করে পিএইচডি ডিগ্রিপেয়েছেন এবং তারপর থেকে আমার লেখা কোথায় কী আছে তিনি খুব আগ্রহভরে তার খোঁজখবর রাখেন । তাঁর কাছ থেকেইজানলাম , প্রফেসর খোন্দকার সিরাজুল হক অত্যন্ত যত্ন করে ‘ পূর্বমেঘ ’ পত্রিকার সব সংখ্যা সংগ্রহে রেখেছেন । তসিকুলইসলাম রাজার কাছেও এই খবর শুনলাম ।
পূর্বমেঘ ’ – এ তিন কিস্তিতে প্রকাশিত ‘ শামুক ‘ – ই এখন বই আকারে বের হচ্ছে প্রকাশকের চাপে । কথাপ্রকাশের জসিম উদ্দিনআমার প্রথম উপন্যাস ছাপবেনই । কাজেই আমি বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি । আমি এই উপন্যাসটির কোনো রকম সংশোধনেযাইনি । বিস্তৃত করা , সংশোধন বা কাটাকাটি করার জন্য হাত লাগাইনি । কারণ তা করলেই আমি জানি , বর্তমানের আমি এরমধ্যে ঢুকে পড়ব । যদি কাঁচা মনে হয় কাঁচাই মনে হোক , দরকচা মনে হয় , দরকচাই মনে হোক , জায়গায় জায়গায় কাঁচা , জায়গায় জায়গায় পাকা মনে হয় হোক , এই নিয়ে আমি ভাবি না ।