সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার রচনা
ভূমিকা :
যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সড়কপথের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম । কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতমসমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । নিরাপদ চলাচলের ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা একটি সার্বক্ষণিক হুমকিস্বরূপ । আমাদের দেশে প্রায় প্রতিনিইসংঘটিত হচ্ছে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা । অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ । পঙ্গুত্ব বরণ করছে অনেকে । প্রতিদিনভোরে খবরের কাগজের পাতা খুললেই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের মর্মান্তিক সংবাদ । সড়ক দুর্ঘটনার মরণ – ছোবল থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি ।
বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা ও যানবাহন :
স্বাধীনতা – উত্তর কালে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট সম্প্রসারণ ও উন্নতি সাধিত হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তাখুবই অপ্রতুল । পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আমাদের দেশে পাকা সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৬০০ কিলোমিটার । এ সড়ক পথেরবেশিরভাগ ছিল সরু এবং ভারি যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী । স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ অবস্থার অনেকউন্নতি হয়েছে । বর্তমানে বাংলাদেশে পাকা সড়কের দৈর্ঘ্য ১৬ হাজার ৭৪০ কিলোমিটার । এর ৪০ ভাগ হাইওয়ে মানসম্পন্ন ।বর্তমানে বাংলাদেশে মোটরযানের সংখ্যা প্রায় সাত লক্ষ । ২০১০–১১ অর্থ বছরে বাংলাদেশে মােটরযানের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ৬৭ হাজার । মোটরযানের পাশাপাশি রয়েছে রিক্সা , ভ্যান , ঠেলাগাড়ি , সাইকেল ইত্যাদি । রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড়শহরগুলোতে যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত ভিড় – যানজট ও দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে ।
সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র :
বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক । দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫ টি বড়ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে । বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে , বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে তিন হাজারমানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় । মারাত্মক পঙ্গুত্ব বরণ করে ১০ হাজারের অধিক মানুষ এবং আহত হয় প্রায় ২০ থেকে ৩০হাজার মানুষ । উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি । বিআরটিএ – এর একজরিপ মতে জানা যায় যে , প্রাণহানি ছাড়াও বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষয় – ক্ষতি হয় ।জীবন বিনষ্ট , পঙ্গুত্ব ও সম্পদের ক্ষতির এ চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ । কোথাও বাসের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষ , কোথাও বাস – ট্রাক সংঘর্ষহচ্ছে , কোথাও টেম্পু – রিক্সা কিংবা নিরীহ পথচারীকে চাপা দিচ্ছে – কেড়ে নিচ্ছে অমূল্য জীবন ।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ :
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার বহুবিধ কারণ রয়েছে । নিচে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো :
১. ক্রটিপূর্ণ যানবাহন ;
২. চালকদের অসাবধানতা ;
৩. দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকের অপ্রতুলতা ;
৪. রাস্তার স্বল্পতা ও অপ্রশস্ততা ;
৫. রাস্তার তুলনায় পথচারী ও যানবাহনের আধিক্য ;
৬ , ধারণ ক্ষমতার বাইরে গাড়িতে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করা ;
৭. বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো ;
৮. বেআইনীভাবে ওভার টেকিং করা ;
৯. ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা ;
১০. পথচারী পারাপারে ট্রাফিক সিগনাল মেনে না চলা ;
১১ , ওভার ব্রিজের স্বল্পতা ;
১২. প্রয়োজনীয় ডিভাইডারের অভাব ।
১৩. রিক্সা , ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির সংখ্যাধিক্য ;
১৪. বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ;
১৫. নিম্নমানের রাস্তা নির্মাণ ও রাস্তা সংস্কারের অভাব ;
১৬. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা ও ট্রাফিক আইন প্রয়োগে শৈথিল্য ; ১৭. বিআরটিএ কর্তৃক ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া;
১৮. যথাযথ যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই অর্থের বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ; উল্লিখিত কারণ ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার আরোনানাবিধ কারণ রয়েছে ।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার :
সড়ক দুর্ঘটনার ফলে সবচেয়ে বড় ও অপূরণীয় যে ক্ষতি সংঘটিত হচ্ছে তা হলো মানব সম্পদের বিনাশ । তারপরেই রয়েছেঅর্থনৈতিক ক্ষতি । সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার ও প্রতিরোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে :
১. গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে চালকদেরকে দক্ষ ও সচেতন হওয়া ।
২. লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালোভাবে যাচাই করা ।
৩. লাইসেন্সবিহীন কেউ যেন গাড়ি চালাতে না পারে ট্রাফিক আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা ।
৪. গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে যান্ত্রিক কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া ।
৫. সাবধানে , গাড়ি চালনার জন্য চালকদেরকে উদ্বুদ্ধ করা । ৬. চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকা । ৭. ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানো থেকে চালকদেরকে বিরত থাকতে হবে ।
৮. রিকন্ডিশন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা ।
৯. গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখা ।
১০. ট্রাফিক আইন লঙ্ঘণকারী চালকের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করা ।
১১. প্রধান ও ব্যস্ত সড়কসমূহে পথচারীদের চলাচলে প্রয়োজনীয় ফুটপাত ও ওভার ব্রিজের ব্যবস্থা করা
১২. সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশদেরকে যথােপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ।
১৩ , অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল পরিবহৃকারী গাড়ি শনাক্ত করে প্রচলিত আইনে শাস্তি প্রদান করা ।
১৪. রাস্তা প্রশস্ত ও সংস্কার করা ।
উপসংহার :
জীবন – জীবিকা ও কর্মের প্রয়োজনে প্রতিনিয়তই মানুষকে সড়ক পথে যানবাহনে আরোহণ করে এক জায়গা থেকেআরেক জায়গায় যাতায়াত করতে হয় । সড়ক পথে মানুষের জীবন আজ মারাত্মক নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে । আমাদের দেশেবর্তমান সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে । সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন ।মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু দুর্ঘটনার অকাল মৃত্যু কারো প্রত্যাশিত নয় । তাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকলকে আন্তরিকভাবে এগিয়েআসতে হবে।